শিরোনাম
শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বপ্নের শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ

রাশেদুর রহমান, রাশিয়া থেকে ফিরে

স্বপ্নের শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ

রাতের অন্ধকার নেই এখানে। বিশেষ করে এই সময়টাতে মোটেও নেই। এখানকার অন্ধকার খুঁজতে মানুষকে নামতে হয় মাটির নিচে। প্রায় একশ তলা বিল্ডিং সমান নিচ দিয়ে চলে মেট্রো রেল। তাতে চড়ে তারা ঘুরে বেড়ায় শহরজুড়ে। ছুটে চলে গন্তব্যের উদ্দেশে। সেন্ট পিটার্সবার্গে ভিন্ন ছবিও আছে। এখানেই শীতকালে দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। আলো-আঁধারির এই খেলা এখানে চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে—

 

মেক্সিকান মেয়েটি বেশ খাটো। ভিড়ের মধ্যে ঠেলেঠুলে এগিয়ে এসে বিনীত অনুরোধ করল, আমাকে একটু উপরে তুলে দিবে? জায়গা ছেড়ে দিতেই অবাক হলো মেয়েটি। এখানে সবাই নিজস্থানে অনঢ়। এমনকি পরিচিত জনকে দেখলেও মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। স্থান ছাড়ার প্রশ্নই যেন উঠে না। ব্যাপারটা কী? এত এত মানুষের ভিড় কেন নিয়েভা নদীর তীরে? লোকমুখে শোনা কথাটা কী তবে সত্যি? এখানে কী সত্যিই অভূতপূর্ব কিছু হবে!

অপেক্ষাটা সেই বিকাল থেকে। বিকালের হিসাবটা অবশ্য এখানে ভিন্নরকমের। ছটায় বিকাল। সন্ধ্যা হতে হতে এগারোটা। তারপর বারটায় রাত হয়েই একটাতে দিন। সত্যি বলতে, এখানে রাতের অন্ধকার নেই। অন্তত বছরের এই সময়টাতে (জুন-জুলাইয়ে) মোটেও নেই। অন্ধকার খুঁজতে এখানকার মানুষকে নামতে হয় মাটির নিচে। প্রায় একশ তলা বিল্ডিং সমান নিচ দিয়ে চলে মেট্রো রেল। তাতে চড়ে তারা ঘুরে বেড়ায় শহজুড়ে। ছুটে চলে গন্তব্যের উদ্দেশে। সেন্ট পিটার্সবার্গে ভিন্ন ছবিও আছে। এখানেই শীতকালে দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। আলো-আঁধারির এই খেলা এখানে চলছে হাজার হাজার বছর ধরে।

 

আলেপারোসা

অনুষ্ঠানটার নাম স্থানীয়দের কাছে আলেপারোসা। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ‘দ্য স্কারলেট সেইলস’ নামে। পৃথিবীর যে কয়টা বৃহত্তম জনসমাগম হয় তার মধ্যে এটাও অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই শুরু হয় এই অনুষ্ঠান। সদ্য স্কুল পাস করা ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটা মূলত ‘হোয়াইট নাইট ফেস্টিভ্যাল’রই (সাদা রাত) অংশ। ২৩ জুনের এই সাদা রাত দেখতে সারা বিশ্ব থেকে এ বছর ত্রিশের লাখেরও বেশি মানুষ এসেছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে নিরাপত্তা প্রহরীদের কড়াকড়ি। বিখ্যাত জাদুঘর ‘হার্মিটেজ’ এলাকা ঘিরে রেখেছে তারা। এখানেই ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা দিবে কর্তৃপক্ষ। তাদের জন্য তৈরি করা বিশেষ পাস ছাড়া ওই সীমানায় প্রবেশাধিকার নেই কারও। সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় কোনো মোটরযান নেই। সবাই হেঁটে বেড়াচ্ছে। স্থানে স্থানে কনসার্ট চলছে। ছোট বড় মিলিয়ে কয়েক শত কনসার্ট শহরজুড়ে। লাখ লাখ মানুষ বিকাল হওয়ার আগেই স্থান পাকাপাকি করে নিল নিয়েভা নদীর তীরে। সাদা রাতের দেখা মিললে এখানেই হবে ইউরোপের সেরা উৎসব। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সত্যিই শুরু হলো উৎসব। সুইডেন থেকে লাল রঙা পালতোলা নৌকা এলো। আবছা আঁধারে ছেয়ে যাওয়া আকাশে চলল আতশবাজি। নদীর তলদেশ থেকে অপূর্ব ছন্দময় এই আতশবাজি দেখতে দেখতে বিমোহিত হলো সারা পৃথিবী থেকে আসা লাখ লাখ মানুষ। নানান ছন্দে পানির নিচ থেকে উঠে আসছে একের পর এক রকেট। খোলা আকাশে গিয়ে রংবেরঙের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক রাত ১২টা ৩৯ মিনিটে শুরু হয়ে শেষ হলো ১টায়। ২১ মিনিটের এই আতশবাজি কল্পনাকেও হার মানিয়ে দিল। আলেপারোসা উৎসবের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রচুর মদ পান। এই রাতে রাশানরা বাড়ি ফেরে না। পার্কে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তায় যে যেখানে সুযোগ পায় আকণ্ঠ মদ গিলে মাতাল হয়। বাঁধনহারা তরুণ-তরুণীরা ছুটে চলে আপনগতিতে। সকাল হলে দেখা যায় মাতালের দল পরস্পরের হাত ধরাধরি করে বাড়ি ফিরছে।

 

পিটারহফ

নববিবাহিত যুগলের নাম আলেক্সান্ডার ও মারিয়া। বরের পোশাক নেভি ব্লু কমপ্লিট স্যুট। কনের গায়ে যথারীতি সাদা বিয়ের গাউন। হাতে সাদা গোলাপ আর অর্কিড ফুলের তোড়া। ভিনদেশি পর্যটক হিসেবে ছবি তোলার আবদার করলে রাজি হয়ে গেল। সেলফি তুলতে দিল হাসিমুখে। পিটারহফ রাশানদের কাছে তীর্থ ভূমির মতো। সেন্ট পিটার্সবার্গবাসীদের কাছে বিয়ের পর এখানে এসে ছবি তোলা বিয়ের অনুষ্ঠানেরই একটা অংশ। সেন্ট পিটার্সবার্গ মেট্রো সার্ভিসের আভতোভো স্টেশন থেকে বাসে চড়ে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। এই পথেই রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশাল বাড়ি। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন লেক। তবে এসব কেবল ট্রেইলার। পিটারহফের সৌন্দর্যের কাছে এসব দুধভাত। অষ্টাদশ শতকে পিটার দ্য গ্রেটের তৈরি করা ‘পিটারহফ’ প্যালেসের সদর দরোজা কালের নিষ্ঠুর করাঘাতে অনেকটা মলিন হয়ে গেছে। জীর্ণ-শীর্ণ। প্রবেশদ্বার পাড়ি দিলেই বিশাল পার্ক। হাজার রকমের ফুল-ফলের গাছ সমৃদ্ধ সুদীর্ঘ পার্ক পাড়ি দিতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। তারপর মূল প্রাসাদ। এখানে টিকিট কাটতে হয় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে। গ্রীষ্মকালে এখানে পর্যটকের ভিড় থাকে প্রতিদিনই। ৭০০ থেকে ১৩০০ রুবল করে টিকিট। নিরাপত্তাপ্রহরীদের তল্লাশি শেষ হলে ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে দ্য গ্র্যান্ড কাসেড এবং স্যামসন ফাউন্টেইন। ফোয়ারার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাশান বীরদের সোনালি রঙের মূর্তি। প্রাসাদের মূল এলাকার ভিতরেও বিরাট পার্ক। প্রতাপশালী জার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট এই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান হিসেবে। এ কারণে অনেকেই এটাকে সামার প্যালেসও বলে। এই পিটার দ্য গ্রেটই সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের গোড়াপত্তনকারী। সম্পূর্ণ আধুনিক রূপে গড়ে তুলেছিলেন এই শহর। রোমান সাম্রাজ্যের ভার্সাই নগরীর আদলে গড়ে তোলা এই শহরটি নানা কারণেই ইউরোপের সেরা শহরগুলোর তালিকায় উপরের দিকে স্থান করে নিয়েছে।

 

গভীরতম মেট্রো লাইন

অ্যালিভেটর নেমেই চলেছে। এ নামার যেন কোনো শেষ নেই। প্রায় তিন মিনিট ধরে নামার পর দেখা মিলল মেট্রো স্টেশনটার। অ্যাডমিরালতেস্কায়া। পৃথিবীর দ্বিতীয় গভীরতম মেট্রো স্টেশন। কারও কারও মতে তৃতীয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে এই স্টেশনটি উদ্বোধন করা হয়। পৃথিবীর গভীরতম মেট্রো স্টেশন সোভিয়েত রাশিয়ারই তৈরি করা। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আসেনালনা মেট্রো স্টেশনটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০৫.৫ মিটার গভীরে। সেন্ট পিটার্সবার্গের অ্যাডমিরালতেস্কায়া স্টেশনটি মাটির ৮৬ মিটার গভীরে। কেবল এই স্টেশনটাই নয়, সেন্ট পিটার্সবার্গে দেখার মতো যে কটা অনন্য নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে মেট্রো লাইন একটা। মাটির এতটা গভীরে কী অপূর্ব সুন্দর মেট্রো লাইন গড়ে তুলেছে রাশানরা। স্টেশনগুলোর ভিতরে প্রবেশ করলে মনে হয় এ যেন কোনো রাজ প্রাসাদ। চারদিকে কারুকাজ করা দেয়াল। কোথাও কোথাও চমৎকার সব ম্যুরাল। সেসব ম্যুরালে রাশিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। আলেক্সান্ডার, পিটার দ্য গ্রেটদের ছবি আঁকা আছে কোথাও কোথাও। সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এলেও রাশানরা জার আমলের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ভুলে যায়নি। সেন্ট পিটার্সবার্গ মেট্রো লাইনে ৬৯টি স্টেশন আছে। ১৯৫৫ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই লাইনে ১২৬টা স্টেশন হওয়ার কথা। ধীরে ধীরে সবগুলো স্টেশনই গড়ে তুলছে রাশানরা।

 

আভিজাত্যের শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ

পিটারহফ আর অপূর্ব সুন্দর মেট্রো লাইন ছাড়াও সেন্ট পিটার্সবার্গে অনেক কিছু আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হার্মিটেজ মিউজিয়াম। এই জাদুঘরে সুপ্রাচীন কালের শিল্প নিদর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের নিদর্শন, কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। হার্মিটেজ জাদুঘরটি গড়ে উঠেছে ছয়টি ইতিহাস খ্যাত স্থাপনা নিয়ে। এর মধ্যে আছে জার সম্রাটদের শীতকালীন প্রাসাদটিও। কেবলমাত্র প্রাসাদটিই দেখার মতো। জার সম্রাটদের গড়ে তোলা এক অপূর্ব নিদর্শন। তার উপরে রাশিয়ান সংস্কৃতির গভীরে ডুব দিতে হলে এই জাদুঘরটি দেখা উচিত। সারা বিশ্ব থেকে জার সম্রাটদের কুড়িয়ে আনা অসংখ্য অ্যান্টিকস স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে। হার্মিটেজের পর আসে পিটার এবং পলের দুর্গের কথা। নিয়েভা নদীতে ছোট্ট একটা দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই দুর্গ। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে নিয়েভা নদীর ওপর দুটি সেতু। পিটার দ্য গ্রেটের আমলেই তৈরি হয় এই দুর্গ। তারকার মতো দেখতে বলে অনেকেই একে স্টার দুর্গ বলে ডাকে। বর্তমানে দুর্গটি স্টেট মিউজিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে এ ছাড়াও আছে কাজান ক্যাথেড্রাল, সামার গার্ডেন, চার্চ অব সেভিয়র অন ব্লাড ইত্যাদি দারুণ স্থাপনা। রাশিয়া বিশাল এক দেশ। তবে সেন্ট পিটার্সবার্গের গুরুত্ব অন্য সব শহরের চেয়ে বেশি। অভিজাত এই শহরটি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও অনেক এগিয়ে।

সেন্ট পিটার্সবার্গের বর্তমান সৌন্দর্য দেখে মনেই হবে না এই শহরটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় আড়াই বছর অবরুদ্ধ ছিল জার্মান বাহিনীর হাতে। খেতে না পেয়ে দশ লাখেরও বেশি মানুষ এই শহরে মারা গিয়েছিল বলে ইতিহাসবিদরা বলেন। ১৯৪৫ সালের ১ মে এই শহরটার নাম বদলে লেনিনগ্রাদ করেন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক স্টালিন। অবশ্য সোভিয়েত আমল শেষ হতেই শহরটি পুরনো নামে ফিরে যায়।

সর্বশেষ খবর