শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
দাবাড়– রানী হামিদ

৭৪ বছর বয়সেও অপ্রতিরোধ্য

তানিয়া তুষ্টি

৭৪ বছর বয়সেও  অপ্রতিরোধ্য

পূর্ণ করেছেন ৭৪ বছর বয়স। এই বয়সেও দিব্যি টেক্কা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়তে আসা তরুণ সব মেধাকে। অপ্রতিরোধ্য দাবার রানী হিসেবেও অর্জন করেছেন সুখ্যাতি। তিনি আমাদের সবার পরিচিত দাবার গ্রান্ডমাস্টার রানী হামিদ। তার পুরো নাম সৈয়দ জসিমুন্নেসা খাতুন। ১৮ আগস্ট জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় ১৯তম শিরোপা জিতলেন দেশের মহিলা দাবার এই পথিকৃৎ। ৩৮টি জাতীয় আসর খেলা রানী হামিদের এটি ১৯তম শিরোপা। অর্জন নিশ্চিত করতে হারাতে হয়েছে ফিদে মাস্টার জাকিয়া সুলতানাকে। দেশে দাবার ইতিহাসে নারী-পুরুষ মিলিয়ে এতবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব শুধু তারই রয়েছে। অপরদিকে ১১ বার শিরোপা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গ্রান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ১৯৮৫ সালে তিনি ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান। তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ নিজের পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করে রোমাঞ্চিত হন। ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক বেশি খুশি লেগেছিল সেদিন। ব্রিটিশরা আমাদের অনেকদিন শাসন করেছে। সেই ব্রিটিশদের হারিয়েই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তারপর আরও দুবার ব্রিটিশ মহিলা ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আর আন্তর্জাতিক মাস্টারের প্রথম নর্ম পাওয়ার মুহূর্তটি আমার কাছে ছিল বিশেষ আনন্দের। আমার জানাই ছিল না, আমি নর্ম পেয়েছি।’ ২০১৭ সালে জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। এরই সুবাদে আগামী নভেম্বর মাসে দাবায় ‘মহিলা ওয়ার্ল্ড কাপ রাশিয়া’-তে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়াও আগামী সেপ্টেম্বরে জর্জিয়ার বাটুমি শহরে দলগত দাবা প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিতে যাচ্ছেন। তিনি জাতীয় মহিলা দাবায় ১৯ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যদিও ১৯৭৭, ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে আরও তিনবার জাতীয় মহিলা দাবায় জিতেন তিনি, কিন্তু তখন রেকর্ড রাখা হতো না। ক্রীড়াক্ষেত্রে নিজের সফল অগ্রযাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা ও স্বামীÑউভয়ের সংসারই ছিল ক্রীড়াবান্ধব। সেখান থেকেই এসেছে আমার মূল অনুপ্রেরণা। পরবর্তী প্রজšে§ও ক্রীড়াবান্ধব এই পরিবেশ অব্যাহত রয়েছে। স্বামী লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ ছিলেন এ দেশের হ্যান্ডবলের পথিকৃৎ। বড় ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াশ, হ্যান্ডবল, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলেছেন। এখন সে স্কোয়াশ অ্যান্ড র‌্যাকেটস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ ববি জাতীয় হ্যান্ডবল দলের সাবেক খেলোয়াড়। মেয়ে জেবিন হামিদ টুকটাক দাবা খেলেছেন। ববি হামিদের মেয়ে সামাহা হামিদ স্কলাস্টিকার হয়ে হ্যান্ডবল খেলে। কায়সার হামিদের ছোট ছেলে সাদাত হামিদ জুনিয়র পর্যায়ে ফুটবল খেলছে।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজে, তার স্বামী এবং ছেলে প্রত্যেকেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। এই বয়সে এসে চাওয়া-পাওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। তেমন কিছু চাইবার নেই। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া ১৫৩ ক্রীড়াবিদের মধ্যে আমি ছিলাম। এই স্বীকৃতি আনন্দের। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতটুকু অসুখী নই। এরপরও কোথায় যেন একটা কথা থেকেই যায়। এ সময়ে এসে ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য পেলে সরকারের তরফ থেকে অনেক পুরস্কার মিলে যায়। কিন্তু আমি মনে করি শেষ বয়স পর্যন্ত সফল ক্রীড়াবিদদের জন্য কোনো না কোনো ভাতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এতে করে খেলা থেকে অবসর নিলেও কেউ আর সামাজিক নিরাপত্তা বা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না।’

অসাধারণ এই প্রতিভাবান নারীর জম্ম ১৯৪৪ সালে সিলেট জেলার সৈয়দ পরিবারে। শৈশব থেকে দাবার বোর্ডের দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল তার। ঝোঁকটা আরও বেড়ে গেল যখন দেখলেন, বাবা মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবা খেলতেন। স্কুল জীবনে ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও অ্যাথলেট ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্রীড়াবিদ হওয়ায় দাবা খেলার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা পান। ১৯৭৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ নিয়ে আসছেন রানী হামিদ। শুরুতে তিনি খুব অ্যাটাকিং খেলোয়াড় ছিলেন। পরে পজিশনাল খেলার দিকে নজর দেন। রানী হামিদ জানান, ‘যুগ বদলেছে। মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই দাবার অনুশীলন মানুষ কম্পিউটারে বসে একাই করছে। সে জন্য কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাকে। আমি তাদের মতো অনুশীলন করতে পারছি না, শুধু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সময় খেলছি। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি যদি বাস্তবিক অনুশীলনের সংস্কৃতি চালু থাকত তবে দাবা খেলা আরও অগ্রসর হতো।’ রানী হামিদ একাধিকবার বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে শুধু মহিলা দল নয়, জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছেন। যে কৃতিত্ব বিশ্বের খুব কম মহিলা দাবাড়ুরই রয়েছে। স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ‘মজার খেলা দাবা’ ও ‘দাবা খেলার আইন-কানুন’ নামে দুটি বই লিখেছেন। অনেক পরিবারের মেয়েরা খেলার প্রতি আগ্রহী থাকা সত্ত্বেও বাইরে নিরাপত্তা, যাওয়া আসার ঝামেলায় নিজেদের বিরত রাখেন। কিন্তু দাবা এমন একটি ঘরোয়া খেলা যেখানে একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েও অনায়াসে খেলতে পারেন। এমনকি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতে পারেন। এতে করে ভালো খেলোয়াড় বেরিয়ে আসা সম্ভব। রানী হামিদের দাবি, ‘দাবা খেলাটি সম্পূর্ণ মস্তিষ্কপ্রসূত একটি খেলা। এই খেলার চর্চা মানুষকে ধীরবুদ্ধিসম্পন্ন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে শেখায়।’

সর্বশেষ খবর