শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বাংলাদেশে ইতালিয়ান আন্না

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বাংলাদেশে ইতালিয়ান আন্না

লেখা : তানিয়া তুষ্টি, ছবি : রাফিয়া আহমেদ

হ্যালো আন্না, হাউ আর ইউ? প্রতিউত্তরে- এই তো ভালো, আপনি কেমন আছেন? একজন বিদেশিনির মুখে এমন জবাব শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই হবে। অন্যদিকে প্রথম সম্ভাষণে ইংরেজিতে বলাটা হয়তো অপরের জন্য ভুল নয়। তবে তার পরিষ্কার বাংলা বলতে পারাটা আপনার ভিতরকার অনেক ভুল ভেঙে দেবে নিশ্চয়। প্রথম সম্ভাষণে সুমিষ্ট বাংলার ব্যবহার কতটা গৌরবের তা আরেকবার প্রমাণিত হবে।

 

ইতালির বেনেবেন্ত থেকে ঢাকার বুকে

আন্না কোক্কিয়ারেল্লা। লেখক ও গবেষক। সুদূর ইতালির বেনেবেন্ত থেকে বাংলার টানে বার বার ছুটে এসেছেন এখানে। ২০০৩  সালে প্রথমবারের মতো বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে আসেন বাংলাদেশে। এরপরই এ দেশের প্রতি একটা টান আর মুগ্ধতা তৈরি হয়। জানতে পারেন এই মাটির ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছেন ইতিহাসের একজন মহানায়ক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২০০৪ সালের দিকে নিজের গবেষণাকর্ম শুরু করলেন এখানেই। তাঁকে ভালোবেসে এখানেই চালিয়ে যাচ্ছেন তার গবেষণাকর্ম। এই মাটি, মানুষ, ভাষা আর জনপদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার আত্মিক বন্ধন। সেই বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে তার মুখে স্পষ্ট সুন্দর বাংলার যে কাউকেই বিভ্রান্ত করবে। কথা বলার সময় অনর্গল বাংলা বলে যেতে পারা বিদেশি নাগরিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু আন্না একেবারেই ব্যতিক্রম। এ কারণেই আলাপের সময় কোনো বাক্যের মাঝে একটি ইংরেজি শব্দ বা নিজের মাতৃভাষা সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি তার। বাংলার প্রচলিত অপ্রচলিত সব শব্দই যেন তার দখলে। আন্নার অন্য পরিচয় হলো, তিনি বাংলার বরপুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের গবেষক। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ইংরেজি ভাষার ইতালীয় অনুবাদক। বাংলাটা রপ্ত করেছেন বেশ কষ্ট করে। এখন তো রীতিমতো বাংলার প্রেমে মজেছেন। ভাষার ইতিহাস তার হৃদয় কাড়ে। শ্রদ্ধায় অবনত হলো সেসব দুঃসাহসিক শহীদের প্রতি।

 

যেভাবে বাংলার বুকে আন্না

ভারতীয় উপমহাদেশের সুফিবাদ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে এই মুল্লুকে আসার চিন্তা করেন আন্না। বন্ধুটি ছিল বাংলাদেশি। যেই ভাবা সেই কাজ। তার সঙ্গে সর্বপ্রথম আসা ২০০৩ সালে বাংলার মাটিতে পা দেওয়া। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দিল্লি শহর চষে বেড়াবেন, শিখবেন হিন্দি, কাছ থেকে দেখবেন নানা রকম ধর্মীয় আচার। কিন্তু বন্ধুর অনুরোধে প্রথমে বাংলাদেশ পরে ভারতে যাওয়া। বাংলাদেশে ল্যান্ড করে অল্পদিন ঘুরলেন ঢাকার দর্শনীয় স্থান, খেলেন ঐতিহ্যবাহী সব খাবার। জানলেন এ দেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাসের কিছু বিষয়। অথচ গন্তব্য কিন্তু ভারত। তাই কয়েক দিন বাদেই যেতে হলো ভারতে। ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে ভারত গেলেন। কিন্তু কোথায় যেন একটি অভাব বোধ করছেন। যত সময় যাচ্ছে তার ভিতরকার অভাবগুলো বার বার তাড়া দিচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে এসে তিনি যে আতিথেয়তা পেয়েছেন, ভারতে তার এক অংশও নাকি পাননি। খুব অভিমান হলো আন্না কোক্কিয়ারেল্লার। কয়েক দিন ঘুরলেন দেশটাতে, তবে চিন্তার মোড় অন্যদিকে। দেশে ফিরে গেলেন তিন মাস পরেই। এরই মধ্যে মনে গেঁথে গেছে বাংলাদেশপ্রীতি। সেখান থেকে যোগাযোগ শুরু হলো। বাংলাদেশি বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে প্রশাসনিক নানা প্রক্রিয়া শেষ করে ২০০৪ সালে ভর্তি হলেন ভাষা ইনস্টিটিউটে। এক বছরের কোর্স শেষ হলো, এরপর আগ্রহ বেড়ে গেল আরও কয়েক গুণ। দ্বিতীয় পার্টে আবার ভর্তি হলেন ২০০৫ সালে। এবার দেশে ফিরে বাংলা নিয়ে চলল গবেষণা, অনুশীলন সবই। পরে আবার ভর্তি হতে চাইলেন কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। তারপর প্রথম দিকে বাংলাদেশের সুফিবাদ নিয়ে গবেষণা চলল কিছুদিন। এরই সঙ্গে বাংলার বিচিত্র ইতিহাস তাকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে ফেলল। তখন তিনি দেখলেন একবিংশ শতকের কেবল শুরু। গবেষণার জন্য মোটামুটি একশ বছর ধরতে হবে। সে হিসাবে বিংশ শতককে বেছে নিলেন তিনি।

 

গবেষণার বিষয় শেখ মুজিবুর রহমান

 ‘আর তাই যদি করি, আমাকে উনিশত সালের শুরু থেকে হিসাব করতে হবে। এদিকে বাংলার যত আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসন থেকে পাক শাসন, ভাষা আন্দোলন সবকিছুর সঙ্গে একটি নাম বয়ে এসেছে। আর তা হলো শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালে তার জন্ম হয়েছে। এই দেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। একটি স্বাধীন স্বার্বভৌমত্বের রাষ্ট্র কাঠামো দিয়েছেন তিনি।’ বলে চললেন আন্না। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু না জন্মালে এই বাংলাদেশের জন্ম হতো না। তৈরি হতো না এমন দুর্দান্ত ইতিহাস। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও সাহসী ছিলেন। বাংলাদেশের জন্য একটি ধ্র“ব সত্য ইতিহাস তিনি। তাঁকে যত জেনেছি ততই আকৃষ্ট হয়েছি। তাই আমার গবেষণার বিষয় হলো শেখ মুজিবুর রহমান।’

 

একজন ক্ষণজন্মার পক্ষেই এতকিছু সম্ভব

আন্নাকে জিজ্ঞেস করা হলো, শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসার প্রধান কারণ কী? এক কথায় উত্তর- ‘তিনি প্রচণ্ড রকমের সাহসী একজন ব্যক্তি।’ আন্না বলেন, বাংলাদেশি বন্ধুর মুখেই প্রথম শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর নাম। তবে এখন তাঁকে যত জানছি ততই প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। একজন ক্ষণজন্মার পক্ষেই হয়তো এতকিছু সম্ভব। দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। পরিবার তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি। নিজের উপার্জনে মনোযোগী হননি। দেশের জন্য সারাক্ষণ চিন্তার পাহাড় নিয়ে ঘুরেছেন। তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব আমার কাছে আরেক নায়কের নাম। আমি দাবি করি, শেখ মুজিবুর রহমানকে যে মর্যাদায় আমরা স্মরণ করি, ঠিক সমমর্যাদায় তাঁকেও স্মরণ করা উচিত। কারণ, একজন রাজনৈতিক ফেরারের স্ত্রী হয়েও সারাটিক্ষণ সমর্থন যুগিয়ে গেছেন। নিজের বিলাসিতার কথা ভাবেননি। এমনকি বড় সংসারের ভার সামলিয়ে বাজারের টাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য সিগারেট কেনার টাকা জমিয়েছেন। স্ত্রী হিসেবে তাঁর কোনো আয়েশি আবদার ছিল না নেতার কাছে। সারাক্ষণ তাঁকেও চিন্তায় থাকতে হতো। বাচ্চারা বাবার মুখ দেখতে পেতেন না দীর্ঘদিন। তাতেও বঙ্গমাতার কোনো আক্ষেপ ছিল না। এমন অমায়িক বুদ্ধিমতী নারী হওয়ার যোগ্যতা সবার থাকে না। আজকের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতার অবদান বর্ণনাতীত।

 

কৃষক পরিবারের আন্না

বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসটাই যেন তার কাছে অনেক বিচিত্র। আন্নার ভালো লাগার জায়গাটাও সেখানে। পৃথিবীর দুটি বিষয় তাকে সবথেকে টানে। এক- নানা রকম সুফিবাদ বা ধর্মীয় আচার, দুই- ইতিহাস। ইতালির বেনেবেন্তের অধীনে ফ্রাননিয়েতো লাবাতে গ্রামে চার বোন, এক ভাই ও বাবা-মায়ের সঙ্গে বড় হয়েছেন। সাধারণ কৃষক পরিবারেই তার জন্ম। ভাবেননি, বড় হয়ে এত দূরের একটি দেশে নিজের প্রেম খুঁজে পাবেন। সাউথ ইতালির লাসা ভিয়েন্স ইউনিভার্সিটিতে ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ বিষয়ে তার পড়ালেখা। পড়ার সুবাদে ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা।

 

অন্যরকম এক মানবী

আন্নার গবেষণার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ অর্থাৎ ২০২০ সালে অথবা বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে। এই দেশের সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, কুষ্টিয়া ঘুরেছেন তিনি। বাংলা ভাষার সবচেয়ে ভালোলাগার শব্দ ‘অভিমান’। খেতে ভালোবাসেন আলুভর্তা ডাল। নিজ হাতে রান্নাও করতে পারেন সব রকম বাঙালি খাবার। তিনি এ ধরনের খাবারেই স্বস্তি পান। ভাষা ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় থেকেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার ও রোকেয়া হলে। তখন বাঙালি সব উৎসবে মেতেছেন একই আনন্দে। কিনেছেন শাড়ি, চুড়ি, ফিতা, আলতা। বাঙালিয়ানার কোনো অংশ বাদ দেননি তিনি। অবসরে গান শোনেন, পুরনো বাংলা সিনেমা তাকে অনেক টানে। বাংলা পুরোটা শেখার পর তিনি আর কোনো ভাবেই এ দেশে বসে অন্য ভাষায় কথা বলতে রাজি নন। তার বাংলা শেখাটাও একটি বড় সংগ্রামী অর্জনের মতো। অনেক মমতা ঘেরা। বিদেশি হওয়ার কারণে সবাই তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে চান। বিষয়টি আন্নাকে বিব্রত করে। আন্না বলেন, এই ভাষার মর্যাদা অর্জনে আপনাদের রয়েছে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, যা বিশ্বের আর কারও নেই। সেই ভাষাকে আমি এতও কষ্ট করে শিখেছি। এখন কেন অন্য ভাষায় কথা বলব? প্রথম দিকে অনেক বাঙালি তাকে যেন জোর করেই ইংরেজি বলিয়ে ছাড়তেন। কিন্তু এখন নাকি আন্না রীতিমতো তাদের বকা দিয়ে বসেন। বাংলা বলতে বাধ্য করেন। সুখ সম্পদের কোনো রকম নেশায় তিনি বিচলিত নন। তার সব সুখের কেন্দ্রে এখন তাৎপর্যময় জীবনের অধিকারী এই মহান নেতাকে নিয়ে গবেষণা করায়।

সর্বশেষ খবর