শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় রন্ধনশালা

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় রন্ধনশালা

খান’স কিচেনে হাতের স্পর্শ ছাড়াই তৈরি হচ্ছে লাখো মানুষের খাবার। ছবিতে খান’স কিচেনের উদ্যোক্তা আফরোজা খান

ঢাকার নতুনবাজার; পাশ দিয়ে সুবজের বুক চিড়ে পিচঢালা ১০০ ফুট সড়ক। এই পিচঢালা পথ ধরেই বেরাইদ ইউনিয়ন। যার একপাশে মানুষের বসতি আরেক পাশে বালু নদ। নদীর ছল ছল পানিতে বর্ষার শেষ রূপ সৌন্দর্যটুকু ছড়িয়ে দিয়েছে বেরাইদের দিক-দিগন্তে। পাশাপাশি শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর মাটিতে শোভা পাওয়া সাদা কাশ ফুলগুলো অভিনন্দন জানাচ্ছে বেরাইদে আগত দর্শনার্থীদের। বেরাইদ ইউনিয়ন এবং এর পাশ কাটিয়ে যাওয়া বালু নদের কোল ঘেঁষে দিব্বি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল উনুন। এই উনুন কোনো বিশালাকার মাটির উনুন নয়, এটি বিশাল এক রন্ধনশালা। দেখলে মনে হবে বিশাল এক রান্নার কারখানা। এখানে শত মানুষের কর্মব্যস্ততায় অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু খাবার। যার পুরোটা সামলাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা আফরোজা খান। অনন্য এই নারী উদ্যোক্তা বিশালাকার রান্নাঘরটির নাম দিয়েছেন ‘খান’স কিচেন’। দেশের তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মেগা কিচেন হিসেবে ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে খান’স কিচেন।

 

ব্যতিক্রমধর্মী ফিউশন নিয়ে কিচেনের উদ্যোগ

আট-দশজন নারীর মতো সংসার সামলানো আফরোজা খান যে নয়া ফিউশন নিয়ে মেগা কিচেনের মালিক কাম রন্ধনশিল্পী তা চট করে বোঝা মুশকিল। কথা বললেই বোঝা যায় তার ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্নÑ সবই রান্না আর খান’স কিচেনকে ঘিরে। দেশসেরা এই মেগা কিচেন সম্পর্কে তার ধারণাও বেশ পরিষ্কার। শখের রান্নাবান্না তো হবেই পাশাপাশি ব্যবসায়ী হিসেবেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। অর্থাৎ, রথ দেখা হলো, কলাও বেচা হলো। আধুনিক মেগা কিচেনটির শুরুর গল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে খান’স কিচেনের এমডি আফরোজা খান মৃদু হেসে বলেন, ‘কখনো ভাবিনি যে, আমি রান্নার জগতে প্রবেশ করব। রান্নাবান্নার প্রতি আকর্ষণ ছিল আগে থেকেই। বুঝতে পারিনি সেই আকর্ষণই আমাকে এখানে পৌঁছে দেবে। মেগা কিচেনটি শুরু করার পর একটি বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু শুরুর গল্পটা একেবারেই ভিন্ন রকম। রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে দিন দিন অসুখে ভুগছে। পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বরাবরই আমাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। সেই থেকে ভাবছিলাম স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিয়ে ভালো কিছু করা যায় কি না! তা ছাড়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রান্নাবিশারদ টনি খানের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। এক দিন কথায় কথায় তিনিও আমাকে ভিন্ন কিছু করার কথা বলেন। আমিও তাকে একটি বড় কিচেন তৈরির প্রস্তাবনাও দিলাম। তিনি তাতে সাড়া দিয়ে কিচেনটিকে আন্তর্জাতিক মানের করার পরামর্শ দিলেন। আমার স্বামীও অভিনব এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সর্বদা সহযোগিতা করে আসছে।’

অত্যাধুনিক মেশিনে স্বল্প সময়ে রান্না

দেশসেরা মেগা কিচেনটি ১৫ বিঘা জায়গার ওপর আন্তর্জাতিক মানে তৈরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেগা কিচেন দেখে এবং রিসার্চ করে পরিকল্পনা মতো এটি তৈরি করা হয়েছে। এখানকার মেশিনগুলো অত্যাধুনিক এবং সব মেশিন জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডস থেকে আনা। কিচেনে ঢোকার আগে বাইরে জুতা খুলে রেখে পরতে হয় আলাদা জুতা। প্রতি জোড়া জুতা স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি। এরপর বাইরের পোশাক পাল্টে প্রতিটি কর্মীকে পরতে হয় নির্ধারিত পোশাক। প্রথমে ঢুকতেই চোখে পড়ে সবুজ রঙের অ্যাপোক্সি ফ্লোর। এরপর দরজা খুলে ঢুকতেই চোখে পড়ে রাইস স্টিমার। এই একটি মেশিনে আধা ঘণ্টায় ৩৮০ কেজি চালের ভাত রান্না হয়। এরকম ১০টি মেশিনে রান্না হচ্ছে ভাত। আরও কয়েকটি মেশিন রয়েছে সংযোজনের অপেক্ষায়। এরপর কক্ষ ঘুরে চোখে পড়ে চাল ধোয়ার মেশিন, সবজির খোসা ছাড়ানো, প্রয়োজনমতো কাটা এবং মসলা পেস্ট করার মেশিন। এ ছাড়া আছে মাছ কাটা ও মাংস কাটার মেশিনও।

 

গুরুত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবারে

শুধু রান্না করলেই চলবে না, আফরোজা খান জোর দেন খাবারের স্বাস্থ্য আর পুষ্টিগুণের ওপরেও। খাবার যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয় সে জন্য পুরো কিচেনকে রাখেন ব্যাকটেরিয়ামুক্ত। রান্নার আগে বা সময় টাইলসের মেঝেতে ময়লা জমার সুযোগ থাকে। কিন্তু এই মেঝে নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করা যায়। প্রতিটি বিভাগের রয়েছে আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট স্থান। ডেঞ্জার জোন (এখানে মাছ, মাংস, সবজি কাটাকাটি এবং ধোয়া হয়), রাইস স্টিমার জোন (এখানে চাল ধোয়া এবং রান্না করা হয়), প্যাকিং এবং ফুড ওভেন জোন এবং ফুড বক্স ওয়াশিং জোন। আফরোজা খান স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরির লক্ষ্যে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো জীবাণুমুক্ত খাবার সরবরাহ করা। এ জন্য সবজি কয়েক দফায় পরিষ্কার করা হয়। আর এই মেশিনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে ল্যাবে টেস্ট করা হয় যেন জীবাণু তৈরি না হয়।’

 

স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ প্রতিদিনের মেন্যু

রান্নায় মায়ের হাতের স্বাদ থাকতে হবে। এ লক্ষ্যেই তেল, লবণ আর মসলার পরিমাণ স্বাস্থ্যসম্মত রাখা জরুরি। এসব বিষয়ে সচেতন থেকে খান’স কিচেনে খাবার তৈরি করা হয়। খাবার যেন স্বাদ আর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ থাকে তাই ভালো মানের শেফ রান্নার দায়িত্বে থাকেন। খাবারের মেন্যুতে স্যুপ, ডাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস এবং মিষ্টান্নও থাকছে। একজন মানুষের এক বেলায় যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন তার সবটুকুই আছে মেন্যুতে। এ ছাড়া স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া উৎসব বা সময় বুঝে থাকে খাবারের বিশেষ ব্যবস্থা। চাইলে কয়েক হাজার অতিথির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান বা পার্টির জন্যও চাহিদামতো মেন্যু অর্ডার করা যাবে।

 

সুলভ মূল্যে খাবার সরবরাহ

খাবারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দাম। দামের ব্যাপারে আফরোজা খান বলেন, ‘দাম যেন খাবারের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে সে বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি। বিভিন্ন দিন বিভিন্ন ধরনের মেন্যু থাকে। আমরা সাধারণত এক্সিকিউটিভ এবং প্রিমিয়াম প্যাকেট করে খাবার সরবরাহ করি। বিকাল ৫টার মধ্যে আমাদের হটলাইন ১৬৫২০ নম্বরে কল করে অর্ডার করলে পরের দিন যথাসময়ে পৌঁছে যাবে দুপুরের খাবার।’

 

নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি

খান’স কিচেন তাদের পুরো রন্ধনশালা পরিচালনার জন্য দক্ষ ৪০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিদিনই নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। এই মেগা কিচেনটি পুরোপুরি চালু হলে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ প্রসঙ্গে আফরোজা খান বলেন, ‘তরুণ সমাজ এখন বেশ সচেতন। আমি মনে করি আমাদের দেশে বেকারত্বের হার অনেকাংশ কমেছে। তরুণরা এখন কোনো কোনো কাজ করে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠছে। কোনো কাজকেই তারা এখন আর ছোট করে দেখে না। যার উদাহরণ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে গড়ে ওঠা খান’স কিচেনের ক্যান্টিন। এখানে ভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রী পার্টটাইম জব হিসেবে কাজ করছে। সরকার এবং ব্যাংকগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভবিষ্যতে বেকারত্ব থাকবে না।’ 

 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

গত বছরের সেপ্টেম্বরে খান’স কিচেন যাত্রা শুরু করে। মতিঝিল, বনানী, ফার্মগেট এলাকার বিভিন্ন হোটেল, খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং কর্মজীবী মানুষের ওপর জরিপ শেষে প্রথম ছয় মাস পরীক্ষামূলক কিচেন পরিচালনা করা হয়। আর তাতেই ব্যাপক সাড়া মেলে। নারী উদ্যোক্তা আফরোজা খান বলেন, ‘মেগা কিচেনে প্রতিদিন এক লাখ মানুষের দুপুরের খাবার রান্না হয় এবং তা পুরো ঢাকা শহরে পৌঁছে দেই আমরাই। বর্তমানে বারিধারা, গুলশান এলাকায়ও আমরা ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য করপোরেট অফিসে নিত্যদিনের খাবার সরবরাহ করছি। পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও খান’স কিচেনের ক্যান্টিনও চালু করেছি। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সুলভ মূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। ভাবছি ঢাকার বিভিন্ন স্পটে ক্যান্টিন আকারে খান’স কিচেন শুরু করব। সব ঠিকঠাক থাকলে খুব শিগগিরই সাধারণের জন্য নতুন এই খান’স কিচেন ক্যান্টিন শুরু হবে।’

লেখা : আবদুল কাদের, ছবি : শনিবারের সকাল

সর্বশেষ খবর