শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বন্ধুর টানে ঢাকায় ফ্রাঙ্কা বর্জা

বন্ধুর টানে ঢাকায় ফ্রাঙ্কা বর্জা

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

ইতালির ভেনিসে থাকেন ফ্রাঙ্কা বর্জা। সেখানেই বাংলাদেশি এক যুবকের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার বন্ধুত্ব। ঢাকায় ছুটি কাটাতে এসে পানিতে ডুবে মারা যায় সে বন্ধু। বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে বসে থাকতে পারেননি ফ্রাঙ্কা। ভেনিস থেকে উড়ে এলেন বাংলাদেশে। বন্ধুর টানে ঢাকায় এসে জানালেন বন্ধুত্বের গল্প। এই দেশকে ভালো লেগে যাওয়ার কথা। ঢাকায় দেখা পেলেন গতিময় চিত্রকর্ম ও সুরের মূর্ছনা।  দেশ, ধর্ম ও মানুষে ভেদাভেদ নেই বলেই মনে করেন তিনি। আত্মসাধনায় খোঁজ করেন শান্তির। ফ্রাঙ্কা পেইন্টিং, লেখালেখি ও মুদ্রা ইয়োগা চর্চায় সুপরিচিত। বাংলাদেশে ইয়োগা সাধনার ওপর একটি বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন তিনি। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবেও রয়েছে তার খ্যাতি।

 

ফ্রাঙ্কা বর্জা। কোনো দেশের সীমারেখা পছন্দ নয় তার। তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ, তোমার ধর্ম কীÑ এমন প্রশ্নও পছন্দ নয় তার। মানচিত্রে দেখানো যে শহরে থাকেন তার নাম ভেনিস। ইতালির দৃষ্টিনন্দন ওই শহর থেকে উড়ে এসে ঘুরে গেলেন ঢাকা। এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন কেবল বন্ধুত্বের গল্প বলতে। পেইন্টিং, কবিতা আর আত্মসাধনায় অন্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ফ্রাঙ্কা। শিল্পমনা ফ্রাঙ্কার চিন্তাধারার সঙ্গে দারুণ বনিবনা হলো এক বাংলাদেশি যুবকের। তার নাম অপু খন্দকার। ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিল অপু। ভাগ্যের নির্মম পরিণতি, পানিতে ডুবে প্রাণ হারান তিনি। বন্ধুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু নাড়া দেয় ফ্রাঙ্কাকে। অনেক খুঁজে বাংলাদেশে বন্ধুর ঠিকানায় উড়ে এলেন। দেশে এসে ফুল হাতে ছুটে গেছেন বন্ধুর কবরের কাছে।

শুধু বন্ধুর জন্য নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য তার প্রাণ কাঁদে। মানুষে মানুষে বিভেদ, জাত, ধর্ম, বর্ণ, দেশের আলাদা পরিচয় আছে বলে মনে করেন না তিনি। ফ্রাঙ্কা বলেন, ‘আমরা সবাই এই পৃথিবীর অংশ। এই প্রকৃতির সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। গাছের শিকড় যেমন মাটির নিচে তার সংসার বুনে, মানুষও তেমন প্রকৃতির সঙ্গে সংসার বুনেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়ও কিন্তু এমনটা দাবি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, প্রকৃতির প্রতিটা উপাদান একে অন্যের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদাণ করতে পারে।’

ফ্রাঙ্কার বাবা ছিলেন চীনের নাগরিক। চীনা মেডিসিনের থিওরিটিক্যাল ফাউন্ডেশন তার হাতেই। পশ্চিমে চীনের চিকিৎসা পদ্ধতির সে সুনাম তার ভিত বুনেছেন তিনি। ফ্রাঙ্কার মা ভেনিসের মানুষ। সেই ভেনিসেই আছেন ফ্রাঙ্কা। শৈশব, কৈশোর কেটেছে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। রাশিয়ার মস্কোয় পড়াশোনা করেছেন। ইউরোপের নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বেড়ে ওঠেছেন একেক দেশের  বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ায়। তার সংস্কৃতিমনা বৈচিত্র্যের শিকড়টাও তাই গভীরে নেমেছে। পেশা হিসেবে কখনোই কিছু স্থির করেননি তিনি। পেইন্টিং তার মনের গল্প বলে। ফ্রান্সে আটশরও বেশি পেইন্টিং নিয়ে তার একক প্রদর্শনী সাড়া ফেলে দেয়। আত্মসাধনা বা ইয়োগা চর্চা করেন তিনি। পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো এই শাস্ত্রীয় কৌশল প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুনি-ঋষিরা তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশল আবিষ্কার বা আয়ত্ব করেন। ফ্রাঙ্কা শরীরের জ্যামিতিক আকৃতির সঙ্গে মনের সম্মিলন ঘটান। আঙ্গুলে বিভিন্ন মুদ্রায় ফুটিয়ে তোলেন মনের ভাষা। প্যারিসে তার চিত্র প্রদর্শনীর সময় এমনই এক মুদ্রা ‘গ্রিন তারা’ ধারণ করে ধ্যানমগ্ন ছিলেন প্রায় এক ঘণ্টা। ইয়োগা নিয়ে সরব ফ্রাঙ্কা। বাংলাদেশ থেকে শিগগিরই ইয়োগার ওপর একটি বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, “আমি এক বছর বয়স থেকেই ইয়োগার বিভিন্ন মুদ্রা ধরতে পারতাম। সেখান থেকেই শুরু। ইয়োগায় শরীর যে ভারসাম্যপূর্ণ আকৃতি ধারণ করে তার সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। ‘ডাবল স্পাইরাল’ বা দুই চাকতি আকৃতি আমার বিশেষত্ব। প্রকৃতির নানা অংশে এর নমুনা রয়েছে। আপনি মেঘের মধ্যে, মহাকাশে নক্ষত্রের মধ্যে এ ধরনের আকার, আকৃতি দেখতে পাবেন। ইয়োগা চর্চায় আমার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে একটি বই লিখতে যাচ্ছি।”

পেইন্টার ফ্রাঙ্কার এর আগে একটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। লেখালেখির প্রতি ঝোঁক আছে তার। পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবেও তার আরেকটি পরিচয় আছে। পশ্চিমা পোশাকে তার নতুন ভাবধারার নকশা প্রশংসিত হয়েছে নানা দেশে। জার্মান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দখল রয়েছে ফ্রাঙ্কার। বাংলাদেশে এসে অল্প সময়েই মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। ফ্রাঙ্কা বলেন, ‘এ দেশের মানুষ সত্যি সুন্দর। এখানকার রিকশায়, বাসে যে ছবি, নকশা আঁকা; এমন শিল্পপ্রীতি পৃথিবীর কোথাও  দেখিনি। পৃথিবীর কোনো জাদুঘরেও এমন শিল্প সংগ্রহ নেই। ঢাকা সত্যিকারের শিল্পনগরী। রাস্তায় রিকশা, সাইকেল, বাস, গাড়ির হর্নও চমৎকার সুর তোলে এখানে। মনে হয়, ছন্দ মিলিয়ে ভাসছে এই সুর। বাংলাদেশি খাবারও দারুণ। এখানে এসে ভাত, সালাদ খেয়েছি।  ঝাল খাবারের কথা না বললেই নয়। এখানকার কাঁচামরিচ খুব পছন্দ হয়েছে।’

বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘আমরা সবাই সবার বন্ধু, আত্মীয়। শান্তি প্রতিষ্ঠাই আমাদের ধর্ম।  ধর্ম, বর্ণের বিভেদ থেকেই মানুষকে অন্য মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ভয়, অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে মুদ্রা ইয়োগার মতো আত্মসাধনা। আমার আদর্শ, শিল্পভাবনার উদ্দেশ্যও তাই শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানুষে মানুষে যোগাযোগ তৈরি করা।’

ফ্রাঙ্কার সঙ্গে কথা বলেছেন-

রণক ইকরাম তানভীর আহমেদ

 

কে এই ফ্রাঙ্কা?

ফ্রাঙ্কার অস্থায়ী ঠিকানা রয়েছে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং ইতালিতে। শৈশব কেটেছে জার্মানিতে। কৈশোরে বেড়ে উঠেছেন সুইজারল্যান্ডে। শরীরবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ছেড়ে এলেন রাশিয়া। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন রাশিয়ার রাশিয়ান স্টেট একাডেমি অব ফাইন আর্টস, সুরিকোভ ইনস্টিটিউট মস্কো থেকে। ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। একাধারে পেইন্টার ও লেখক তিনি। কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন ইয়োগা চর্চার ওপর একটি বই। মুদ্রা ইয়োগা চর্চা করেন। ইয়োগা চর্চার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সুচিন্তার বন্ধন তৈরি করতে চান। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে নিজস্ব ফ্যাশন ভাবনা প্রকাশ করতে যাচ্ছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর