শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্রিটেনের বুকে বঙ্গবন্ধু

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

ব্রিটেনের বুকে বঙ্গবন্ধু

রবিবার। ব্রিটেনের দুপুর। এ সময় বেশির ভাগ রাস্তাই যেন সুনসান নীরব থাকে ব্রিটেনে। কিন্তু কিছুটা ব্যতিক্রম ইস্ট লন্ডনের সিডনি স্ট্রিটের একটি বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির জনাবিশেক মানুষ। সবাই যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে  দেখলে মনে হয় কোনো স্বপ্ন পূরণের দৃশ্য  দেখছেন তারা। 

এরই মধ্যে একগুচ্ছ চেরিফুল নিয়ে বাবার হাত ধরে  স্পপ্ন পূরণের দৃশ্য দেখতে এলো অক্ষর।  ‘বঙ্গবন্ধু? চিনি তো। বাবার মুখে অনেক গল্প শুনেছি। ইউটিউবে তাঁর কথাও শুনেছি। আমি তাঁকে নিয়ে লিখা অনেক বই পড়েছি। আজ তাঁকে দেখলাম। আগে কম্পিউটারে দেখেছি এখন অন্যরকমভাবে দেখলাম।’- বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো গড়গড় করে বলছিল ২০০ মাইল দূরের শহর ম্যানচেস্টার  থেকে আসা শিশু অক্ষর। দশ বছরের অক্ষরের মতো কোটি মানুষের স্বপ্নের বঙ্গবন্ধুর  আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছেন আফসার খান সাদেক নামের একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি। নিজ বাড়ির সামনে কালো রঙের পাথরে তৈরি মূর্তিটি যেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে প্রিয় নেতা, প্রিয় মানুষের অবয়ব দেখার কিছুটা হলেও সুযোগ তৈরি করেছে হাজারও মানুষের মাঝে। বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের বিষয় নিয়ে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের পর থেকে এক অন্যরকম অনুভূতি হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু কতটা জনপ্রিয় না দেখলে বোঝা যায় না। অনেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনে হয় কাছ থেকে আমাদের নেতাকে দেখছেন। এই সিডনি ষ্ট্রিট এখন বঙ্গবন্ধু ে প্রেমীদের জন্য একটি বিশেষ জায়গায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সফরে আসা মন্ত্রী, এমপি, নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষ ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি দেখতে। একই সঙ্গে প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষও দেখতে আসেন বাংলাদেশের প্রিয়  নেতা বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি।

কিন্তু ব্রিটেনের বুকে এমন এক স্থাপনার কাজটি সহজ ছিল না বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান আফসার খান। তিনি বলেন, যখন ব্রিটেনে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বিশ্বের বড় বড় নেতার প্রতিকৃতি দেখতাম তখন আমার মনে প্রশ্ন আসত আমার নেতার প্রতিকৃতি নেই  কেন? এরমধ্যে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক যখন ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর ছিলেন তখন এক উদ্যোগ নেওয়া হয় ক্যামডেন কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্থাপনের। তখন জামায়াত-বিএনপির চক্রান্ত সেই পরিকল্পনাকে বাস্থবায়ন করতে দেয়নি। কিন্তু তারও আগে ২০০৯ সালে টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের সঙ্গে আবার  যোগাযোগ করি আমি। এরপরই বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের অনুমতি মেলে আমাদের। তারপর ২০১৪ সালের জুন মাসে তৎকালীন নির্বাহী মেয়র লুতৎফুর রহমানের সহায়তায় কাউন্সিল অনুমতি প্রদান করে এবং প্লানিং পারমিশন অনুমোদন দেওয়া হয়। আফসার খান সাদেক বলেন, ঠিক এরপরই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেন সফরে আসেন। তখন আমি তাকে, শেখ  রেহানা এবং টিউলিপ সিদ্দিককে অনুমোদনের কাগজ দেখাই এবং স্থাপনের অনুমতি চাই। তারা সানন্দে রাজি হন। রেহানা আপা তো বিস্মিত হন, কারণ ইস্ট লন্ডনে প্লানিং পারমিশন পাওয়া এত সহজ নয়। এছাড়া এখানে জামায়াত- বিএনপি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। আবক্ষ মূর্তির ডিজাইনের কাজ দওয়া হয় ভারতের বিখ্যাত প্রতিকৃতশিল্পী পায়েল চক্রবর্তীকে। ২০১৬ সালে আবক্ষ মূর্তিটি আফসার খান সাদেক কার্গো শিপমেন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এটিকে স্থাপন করতে সময় লাগে। এরমধ্যে কাউন্সিলের কর্মকর্তারা নিয়মিত ভিজিট করে দেখেছেন কাজটি প্লানিং পারমিশন মাফিক হচ্ছে কিনা। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য, সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তিটি।

স্থাপনের পর থেকে বাধা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জনপ্রিয় নেতার আবক্ষ মূর্তি দেখতে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। যা দেখে একটি কুচক্রী মহল আবারও কাউন্সিলে কমপ্লেন করে আবক্ষ মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার জন্য। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কোর্টে শুনানি হয়।  শেষ পর্যন্ত জয় হয় আফসার খান সাদেকের। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল তিনি কোর্টের রায় হাতে পান।  কোর্ট কাউন্সিলের অভিযোগকে খারিজ করে দিয়েছে। তাই আর আইনগত কোনো বাধা আর কখনোই আসবে না বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার জন্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই আবক্ষ মূর্তিটি হ্যারি জ্যাকসন নামের একটি ট্যুর গাইড কোম্পানির ইস্ট লন্ডনের দর্শনীয় বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। তারা তাদের প্রতি রবিবারের ট্যুরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ  থেকে আসা ট্যুরিস্টদের ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখাতে নিয়ে এলে সিডনি স্ট্রিটে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর মূর্তির সামনে ২০ মিনিটের একটি সেশন করে। সেখানে ২০-২৫ জন ভিন্ন ভাষাভাষী, সংস্কৃতির মানুষ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানেন। এ সময় আফসার খান সাদেকও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর  দেন। এভাবেই একজন জাতির জনকের জীবনীর ফেরিওয়ালা হয়ে গর্ব বোধ করেন আফসার খান সাদেক।

সর্বশেষ খবর