শিরোনাম
শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

৬৭ বছর বয়সে সাঁতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যর চমক

আলপনা বেগম, নেত্রকোনা

৬৭ বছর বয়সে সাঁতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যর চমক

আমেরিকান সাঁতারু ডায়ানার রেকর্ড ভেঙে দিয়ে গিনেস বুকে নাম উঠানোই সাঁতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যর একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই স্বপ্ন পূরণেই অবিরাম ১৮৫ কিলোমিটার নদীপথ সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। ৬৭ বছর বয়সে তিনি ৬১ ঘণ্টা লাগাতার সাঁতার কেটে ইচ্ছা পূরণ করলেন। দূরপাল্লার সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন পূরণ হলো নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যর। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো না মিললেও যেটুকু মিলেছে তাতেই হৈচৈ পড়ে গেছে চারদিকে।

 

যেভাবে চ্যালেঞ্জের মূল মঞ্চে

শিশুকাল থেকে সাঁতরাচ্ছেন এমনটিও নন। অন্যজনের সাঁতার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কলেজে পড়ার সময় অনুশীলন করতে করতে দেখিয়ে দিলেন জয় করা কাকে বলে?

তিনি টার্গেট করেছিলেন ১৮৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আমেরিকার ডায়না নায়াদের ১৭৭ কিলোমিটারের রেকর্ড ভাঙবেন। গত ২০১৫ থেকে লাগাতার চেষ্টা করেও সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। অবশেষে নিজ উদ্যোগে ২০১৭ সালে এলাকাবাসী ও ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় দেখিয়ে দিলেন অদম্য ইচ্ছাশক্তি বয়সকেও হার মানায়। ১৫৬ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আত্মবিশ্বাস স্থাপন করেন। ২০১৭ সালের ৪ আগস্টের সেই অবিরাম সাঁতারের পরও অতৃপ্তির  ঢেঁকুর তুলেছিলেন ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। কারণ লক্ষ্য পূরণের তখনো ঢের বাকি!

 

এবার ১৮৫ কিলোমিটার

৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ব্রিজ থেকে সাঁতার শুরু করেন। ভোগাই, কংস নদী ও মগড়া নদী হয়ে টানা ৬১ ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর ৫ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় নেত্রকোনার মদনের মগড়া নদীর দেওয়ান বাজার ঘাটে পৌঁছান। এ খবরে দুপুর থেকেই হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু মগড়া নদীর বিভিন্ন ঘাটে ও আনাচে-কানাচে অপেক্ষা করতে থাকে। তাকে দেখেই উল্লাসে ফেটে পড়েন দর্শকরা। নালিতাবাড়ির নির্বাহী কর্মকর্তা এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এ সাঁতার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।  এবার ১৮৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সত্যিই দেখিয়ে দিলেন ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। আর এবার তা প্রমাণ করে জেলায় জলমানব হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।

 

অনুপ্রেরণার উৎস

১৯৭০ সালে তিনি যখন সিলেটে বিএসসিতে অধ্যয়নরত, তখন ধূপাদীঘি পুকুরে সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দীর ৩০ ঘণ্টার অরিরাম সাঁতার দেখে অনুপ্রাণিত হন। এরপর সিলেট চালী বন্দর ছড়ার পাড়ে সর্বোচ্চ একটানা ৫ ঘণ্টা করে সাঁতার চর্চা করেন। ৫ ঘণ্টার পর তিনি বর্তমান সিলেট এমসি কলেজের হোস্টেল পুকুরে ১০ ঘণ্টা চর্চা করে সফল হন।

 

সাঁতারু হয়ে ওঠা

১৯৭০ সালে নিজ উপজেলা মদন চেয়ারম্যান বরাবর ১৫ ঘণ্টা সাঁতার করার জন্য আবেদন করেন। তৎকালীন চেয়ারম্যান আবেদনে সাড়া দিয়ে মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর ভেনাস ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগ নেন। সেই সালের ২৯ নভেম্বর তিনি ১৫ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার প্রদর্শন করে জীবনের প্রথম মদনবাসীর হৃদয়ে জায়গা করেন নেন। এরপর সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে সিলেট বঙ্গবীর ক্লাব ও পদার্থবিদ্যা সরকারি কলেজ বিভাগের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২ অক্টোবর ২ বারের মতো ৩৪ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটেন। একে একে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সুনামগঞ্জের সরকারি হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেন। জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর বিকাল ৪টা থেকে শুরু করে ১৯ তারিখ ভোর ৪টা ৫ মিনিট পর্যন্ত জগন্নাথ হলের পুকুরে ১০৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করেন।

এছাড়াও তিনি অষ্টম প্রদর্শনীতে ১৯৭৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে ষ্টেডিয়াম সুইমিং পুলে ৭৯ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কাটেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আবার জগন্নাথ হলের পুকুরে জগন্নাথ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় ১০ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের সাঁতার প্রদর্শন করেন। দশম প্রদর্শনীতে ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট নিজ এলকার মদন পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মদন উপজেলা পরিষদ পুকুরে ১৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করেন। ২০১৪ সালে নেত্রকোনা মিউনিসিপ্যালিটি পুকুরে ২৪ ঘণ্টা সাঁতার কেটে ১১তম প্রদর্শনীতে আলোচিত হন।

 

দূরপাল্লার সাঁতারে আগ্রহ

এদিকে ১৯৮০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের ভগীরথী নদীতে ৭৪ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারে তিনি ৯ম স্থান অধিকার করেন। ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদ বহরমপুর (জঙ্গিপুর হতে গোদারীঘাট পর্যন্ত) সাঁতারে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। এরপর ১৯৮১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মগড়া নদীতে ৫০ মাইল দূরপাল্লার একক সাঁতারে অংশ নেন। নেত্রকোনার কালীবাড়ি ঘাট হতে মদন জাহাঙ্গীরপুর ঘাট পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন ও সিপিবির জেলা শাখার ব্যবস্থাপনায় ১৬ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করেন।

২০১৭ সালে ময়মনসিংহের ফুলপুর কংশ নদের ঠাকুর বাঘাই ঘাটের সরচাপুর থেকে ৪ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৬টা ৫০ মিনিটে ১৪৬ কিমি দূরপাল্লার সাঁতার শুরু হয়। অবিরাম ৪৩ ঘণ্টা সাঁতরিয়ে ৬ আগস্ট রবিবার দুপুরে ১টা ৫০ মিনিটে নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া ব্রিজে থামেন। এ সময় এলাকার লাখো মানুষ তাকে উৎসাহ দিয়ে পানি থেকে বরণ করে নেন।

 

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

 ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গণভবনে রুপার নৌকা পুরস্কার পান। ডাকসু কর্তৃক সম্মাননাসূচক স্বর্ণপদক, ১৯৭৫ এবং ৭৬-এ দুইবার জগন্নাথ হল কর্তৃক সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক পন। এভাবে ২১টির মতো সংবর্ধনা, স্বর্ণপদক, চেক, নগদ টাকাসহ বিভিন্ন পদকপ্রাপ্ত হন। এছাড়াও ৮২ ঘণ্টার অবিরাম সাঁতারে রেকর্ড সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট এমসি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে ‘সাঁতার আলোকচিত্র’ সংরক্ষণ করা হয়। ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিটের অবিরাম সাঁতারে ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার পর সব ক্লাসে ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে বিজয় মিছল অনুষ্ঠিত হয়।

 

শিক্ষা ও কর্মজীবন

১৯৭৯ সালে তিনি এমএসসি (ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স) সমাপ্ত করেন। কর্মজীবনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এএনএস কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগদান করে এখনো পর্যন্ত স্বপদে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর