শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ডা. জুবায়ের চিশতীর অনন্য উদ্ভাবন

সাইফ ইমন

ডা. জুবায়ের চিশতীর  অনন্য উদ্ভাবন

ডানপিটে ছেলেটির বেড়ে ওঠা একেবারে প্রকৃতির কোলে। ময়মনসিংহের উস্থিহরিপুর গ্রামে। তেরশ্রী স্কুল থেকে প্রাইমারির গণ্ডি পেরোনোর পর কান্দিপাড়া আস্কর আলী হাইস্কুলে চলছিল পড়াশোনা। অ্যাথলেট হিসেবে এলাকায় তখন ছেলেটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। লং জাম্প, হাই জাম্প থেকে শুরু করে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা সবকিছুতেই প্রথম হতে থাকেন। বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলেও মা পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়। গ্রামে থাকলে ছেলের পড়াশোনা ঠিকঠাক হবে না ভেবে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ঢাকায়। আর এখানে তিনি থাকতেন বাবার কাছে। বলছিলাম আবিষ্কারক ডা. জুবায়ের চিশতীর কথা।  আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই সাধারণ দেখতে, কিন্তু উদ্ভাবন কাজ করেন অসাধারণ। বাঁচিয়ে দেন লাখ লাখ রোগীর প্রাণ। এরকমই একজন আবিষ্কারক হচ্ছেন ডা. মোহাম্মদ জুবায়ের চিশতী। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় প্রায় দুই দশক গবেষণার মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন। তিনি এবং তার সহকর্মী কিছু ব্যবহৃত শ্যাম্পুর বোতল নেন। সেগুলোতে কিছু পানি ভরেন। বোতলের এক প্রান্তে একটি নল যুক্ত করে দেন। অক্সিজেনের উৎস থেকে শিশু অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং শ্বাস ত্যাগ করছে। ত্যাগ করা শ্বাসটি নাকে যুক্ত পাইপের মাধ্যমে চলে আসছে ওই পানিভর্তি বোতলের ভিতর। ফলে বোতলের ভিতরে তৈরি হচ্ছে বুদবুদ। এই বুদবুদ আবার এক উপায়ে ফুসফুসের সঙ্গে যুক্ত। বায়ুর বুদবুদ চাপ প্রদান করে, সেই চাপ গিয়ে লাগে ফুসফুসে। বহির্মুখী চাপের ফলে ফুসফুস সংকুচিত হয়ে যেতে পারে না। এ কারণে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে এবং ফলাফলস্বরূপ বেঁচে যেতে পারে নিউমোনিয়া থেকে। ১৯৯৮ সালের দিকে এরকম কিছু শিশুর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন জুবায়ের চিশতী। ইন্টার্নিরত অবস্থায় চোখের সামনে তিনটি শিশুকে নিউমোনিয়ার যন্ত্রণায় মারা যেতে দেখেন। এ ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। তাদের যন্ত্রণা প্রতিরোধে কিছু না কিছু একটা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারই ফলাফল আজকের প্লাস্টিক বোতলের চিকিৎসা। এমবিবিএস পাস করার পর থেকেই নিউমোনিয়া সংক্রান্ত অনেক গবেষণার সঙ্গে ডা. জুবায়ের চিশতী জড়িত। নিউমোনিয়ার ওপর তার অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আছে। তার চিকিৎসায় অনেক শিশু সুস্থ হয়েছে ইতিপূর্বে এবং বর্তমানেও অনেক শিশু চিকিৎসাধীন।

ডা. জুবায়ের বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ফুসফুস তরল শ্লেষ্মা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়, ফলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়।

ডা. জুবায়ের বলেন, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা যে নেই তা বলা যাবে না, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা যে আগেও ছিল না তা বলা যাবে না। তবে সেসব চিকিৎসা ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। উন্নত দেশগুলোতে কৃত্রিম ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখা হয়। এরকম একটি যন্ত্র কিনতে গেলে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়। আবার এই যন্ত্রটিকে চালাতেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন। খরচ কমাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিকল্প পদ্ধতিতেও প্রতি সাতটি শিশুর মাঝে একটি শিশু মারা যায়।

তারপর অস্ট্রেলিয়াতে ডা. জুবায়ের নতুন একটি চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পদ্ধতিতে ফুসফুসে লাগাতার বায়ুর চাপ প্রদান করা হয়। ফলে ফুসফুসের কার্যক্রম সচল থাকে। এ পদ্ধতিকে বলা হয়  Continuous Positive Airway Pressure (CPAP)। কিন্তু এটিও বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আর বাংলাদেশেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশি শিশু মারা যায়। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন ডা. জুবায়ের চিশতী। CPAP পদ্ধতি তৈরি করার কথা ভাবেন প্লাস্টিকের বোতলের মাধ্যমে। 

আইসিডিডিআরবির হয়ে বিকল্প তৈরির কাজেও লেগে যান। দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে সাফল্যও পান ডা. জুবায়ের চিশতী। এর মাধ্যমে প্লাস্টিকের বোতলে অক্সিজেনের উৎস থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং শ্বাস ত্যাগ করছে। ত্যাগ করা শ্বাসটি নাকে যুক্ত পাইপের মাধ্যমে চলে এসে বোতলের ভিতরে তৈরি হচ্ছে বুদবুদ। এই বুদবুদ আবার পাইপের মধ্য দিয়ে চাপ দিচ্ছে ফুসফুসে। এর ফলে ফুসফুস সংকুচিত হয়ে যেতে পারে না

এবং শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুহার কমে আসছে শতকরা ৭৫ ভাগ। আর এই প্রক্রিয়াটি বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে।

সর্বশেষ খবর