শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দ্রৌপদী কা ডান্ডা-২ এর শিখরে বাংলাদেশের পতাকা

ইকরামুল হাসান শাকিল

দ্রৌপদী কা ডান্ডা-২ এর শিখরে বাংলাদেশের পতাকা

ঝড়ের তেজ কমছেই না। আমরা তাঁবুতে সাতজন। ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। কোনোভাবেই তাঁবু রক্ষা করতে পারছি না। তিন-চার ঘণ্টা ধরে একই অবস্থা। যদি তাঁবু ভেঙে যায় তাহলে আমাদের স্লিপিং ব্যাগসহ সব পোশাক ও জিনিসপত্র তুষারে ভিজে যাবে। আর ভিজে গেলেই হলো, অভিযান শেষ। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে ২০ ডিগ্রি। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে তুষারও তাঁবুর ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তাই স্লিপিং ব্যাগসহ সব পোশাক ও জিনিসপত্র বড় পলিপ্যাকে ঢুকিয়ে ফেললাম। ভয়ঙ্কর একটি সময় পার করছি। রাত বারোটার দিকে ঝড় থেমেছে। ঝড় থামলেও তুষারপাত থামেনি। আমরা তাঁবু থেকে বাইরে এসে দেখি আমাদের বেশির ভাগ তাঁবুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাঁবু তুষারের ভিতরে অর্ধেক ডুবে আছে।

চার দিনের ট্রেকিং শেষে ৪ মে আমরা বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছাই। আবহাওয়ার সঙ্গে আমাদের শরীর মানিয়ে নিতে এখানে আমাদের তিন চার দিন থাকতে হবে। এই কয়দিন আমরা ডুকরানি বামক গ্লেশিয়ারে কাইম্বিং প্র্যাকটিস করেছি। ৮ মে আমাদের বেসক্যাম্প থেকে অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে আসার কথা। কিন্তু আবহাওয়া সকাল থেকেই খারাপ হওয়ায় যাওয়া হলো না। সারাদিন তাঁবুর ভিতরেই কাটাতে হলো। গত কয়েকদিন টানা তুষারপাত হওয়াতে হাঁটু পর্যন্ত বরফ জমেছে। বরফের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ৬ ঘণ্টা পর অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছাই। এখানে আমরা প্রতি তাঁবুতে সাতজন করে থাকি। পাশের উঁচু পাহাড় থেকে একটু পরপর তুষারধস হচ্ছে চারপাশ কাঁপিয়ে। রাতে একটি বড় তুষারধস আমাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়েই চলে যায়। সকালে সেই তুষারধস দেখে সবারই চোখ কপালে। একটুর জন্য আমাদের ক্যাম্প রক্ষা পেয়েছে। তবে যেখান থেকে আমাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় তার ওপর দিয়েই ধসটি চলে গেছে।

আজ ভোরেই জনলির কাঁধ ঘেঁষে সূর্য তার অস্তিত্ব জানান দিল। আমরা আজ ক্যাম্প-১ পর্যন্ত রোড ওপেন করতে ও মালামাল রেখে আসতে ট্রেকিং শুরু করলাম। পুরো পথটিই একটি গ্লেশিয়ারের ওপর দিয়ে। হাঁটু পর্যন্ত তুষার তাই এগিয়ে চলতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। পুরোটা পথে অসংখ্য ওপেন ক্রেভার্স ও হিডেন ক্রেভার্স। তাই খুবই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কঠিন কঠিন চড়াই পার হয়ে আমরা ক্যাম্প-১ এ পৌঁছাই। এখানে একটি তাঁবু করে তার ভিতরে মালামাল রেখে আবার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে ফিরে আসি। সারারাত তুষারপাতে ক্যাম্প-১ এর পথ আগের মতোই বরফে মিলিয়ে গেছে। তাই নতুন করে আবার রোড ওপেন করে ক্যাম্প-১ আসতে হয়েছে। এখানে যে তাঁবুতে মালামাল রেখেছিলাম সেই তাঁবু রাতের ঝড়ে ভেঙে বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তাঁবু লাগিয়ে এর ভিতরেই দুপুরের খাবার তৈরি করতে হলো। সামিটের রোড ওপেন করতে যেতে পারছিলাম না খারাপ আবহওয়ার জন্য। অবশেষে রাত ৩টায় ক্যাম্প-১ থেকে সামিটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত বরফ ঠেলে কঠিন খাড়া চড়াইয়ে দড়ি ফিক্সড করতে করতে আর রোড ওপেন করে স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলছি। ১৪ মে ভারতীয় সময় সকাল ৯টা ২২ মিনিটে ১৮ হাজার ৭১১ ফুট উঁচু ভারতের উত্তরাখন্ড অঞ্চলের গারওয়াল হিমালয়ের দ্রৌপদী কা ডান্ডা-২ এর চূড়ায় পৌঁছাই। তুলে ধরি গর্বের অহংকারের লাল-সবুজের পতাকা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পাঁচটি দেশের ৪২ জন্য অভিযাত্রীর মধ্যে ৩৯ জন্য সফলভাবে আরোহণ করি। এই অভিযানটি নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং-এর পর্বতারোহণের উচ্চতর প্রশিক্ষণের অংশ।

লেখক : পর্বতারোহী

সর্বশেষ খবর