শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মহানুভবতার এক দেয়াল

মহানুভবতার এক দেয়াল

শৈশব থেকে শিশুদের মধ্যে মহানুভতা জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে এক অভিনব দেয়াল। এর নাম ‘মহানুভবতার দেয়াল’। লিখেছেন- জয়শ্রী ভাদুড়ী

 

ছিমছাম সাজানো-গোছানো স্কুল। ভিতরে ঢুকে দেখা যায় সামনের দেয়ালে কিছু হ্যাঙ্গার ঝুলানো। শিশুরা কেউ কেউ জামাকাপড় ঝুলিয়ে রাখছে, কেউ আবার নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের টেবিলে খাতা, পেনসিল, কলম, রং, তুলিসহ বিভিন্ন রকমের উপকরণ রাখা হয়েছে। এগুলো অনেক শিশু রাখছে আবার অনেকেই নির্দিষ্ট কিছু তুলে নিচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি। বিষয়টি একটু খটকা লাগলে খোলাসা করলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তানজিনা নাজনীন মিষ্টি। তিনি বলেন, আমরা এটার নাম দিয়েছি মহানুভবতার দেয়াল। শিশুদের যেগুলো প্রয়োজন নেই সেগুলো এখানে এনে রাখা হয়, আবার এগুলো যে শিশুর প্রয়োজন পড়ে সে নিয়ে যায়। ইন্টারনেটে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ এই আইডিয়াটা চোখে পড়ে। তখনই ভাবলাম শৈশব থেকে শিশুদের মধ্যে যদি এই মহানুভবতা জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে ভবিষ্যতে উদার মনের মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে ওরা। পরের দিন স্কুলে গিয়ে আমার সহকর্মী মো. রহমতউল্লাহ, আইরিন এবং পরেশ চন্দ্র সূত্রধরের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করি। সবাই মিলে মহানুভবতার দেয়াল ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দিই। কালো মার্কার দিয়ে ওপরে কিছু হ্যাঙ্গার টানিয়ে লিখে দিই মহানুভবতার দেয়াল। এরপর বামপাশে লেখা হয় ‘তোমার যা প্রয়োজন নেই তা এখানে রেখে যাও।’ আর ডান পাশে লেখা ‘তোমার দরকারি জিনিস পেলে নিয়ে যাও।’ প্রথম দিন আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র এনে রাখি। এরপর শিশুরাও আনতে শুরু করে। গত মাসে শুরু করা এই কাজে আমরা খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। এলাকাবাসীও আমাদের সহযোগিতা করছেন। ঈদের আগে শিশুদের জন্য ঢাকা থেকে পোশাক পাঠিয়েছিলেন একজন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহানুভবতার দেয়ালে উপকরণ পাঠাচ্ছেন আগ্রহীরা। মহানুভবতার দেয়াল নিয়ে কোনো মজার গল্প জানতে চাইলে হাসি উছলে পড়ে তানজিনা নাজনীন মিষ্টির কণ্ঠে। বলেন, একবার বাড়ি থেকে একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগ এনেছি। মহানুভবতার দেয়ালে রাখার পর দুজন শিক্ষার্থীর ওই ব্যাগ পছন্দ হয়েছে। এখন কে নেবে এটা নিয়ে তৈরি হয় সমস্যা। পরে আরেক শিক্ষার্থীর বুদ্ধিতে লটারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই মহানুভবতার দেয়াল করার পর অনেক বাস্তবতা আমাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আমাদের এক শিক্ষার্থী আছে ওর নাম লামিয়া আক্তার। কিছু দিন আগে লামিয়ার স্কুলের পোশাক পুরনো হয়ে যাওয়ায় ছিঁড়ে যায়। রিকশা চালক বাবার টানাটানির সংসারে ওর জন্য নতুন পোশাক কিনে দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিল না। দুই দিন পরেই এক শিশু তার পুরনো স্কুলের পোশাক রেখে যায় মহানুভবতার দেয়ালে। মহানুভবতার দেয়াল থেকে লামিয়া নিজের জন্য পোশাকটি নিয়ে যায়। শিশুর মুখের ওই স্নিগ্ধ খুশিটুকু এখনো চোখে লেগে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন তানজিনা নাজনীন মিষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ অরণ্য আর প্রাণখোলা বাতাস মিষ্টিকে শিখিয়েছে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে। ৩৪তম বিসিএস নন ক্যাডার হিসেবে তিনি ১০ মাস আগে যোগদান করেন কিশোরগঞ্জ সদরের দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ে যোগদানের পরেই বদলে যেতে থাকে এখানকার চিত্র। সম্প্রতি শিশুদের আত্মরক্ষা শেখাতে কারাতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তানজিনা নাজনীন মিষ্টি জানান, সপ্তাহে চার দিন শিশুদের কারাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়াতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক কামরুল হাসান আমাদের স্কুলে এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখন শিখছে। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্কুলের মা সমাবেশ হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়মিত মা সমাবেশ করা হয়। গত মা সমাবেশে সন্তানরা মায়ের পা ধুয়ে দেন। পৃথিবীতে মায়ের মতো আপন এবং ভালোবাসার কেউ হয় না। শিশুদের মধ্যে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে মায়েরা যেমন খুশি তেমন শিশুরাও। আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা নিয়মিত হোম ভিজিট করেন। কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে না এলে শিক্ষকরা গিয়ে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একটি টিম গঠন করা হয়েছে খুদে ডাক্তারদের। শিশুদের সমন্বয়ে গড়া এই টিম তাদের সহপাঠীদের কেউ আঘাত পেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকে। শিক্ষকরা এ সময় উপস্থিত থাকেন। শুধু তাই নয় দুপুরের খাবারও এখন শিশুরা বন্ধুদের সঙ্গে বসে খায়। প্রতিটি ক্লাসে একটি সেলফ রাখা হয়েছে। সবাই খাবার এনে এই সেলফে রেখে দেয়। টিফিন হলে একসঙ্গে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া-দাওয়া চলে। দুপুরে শিশুরা কী খাবার খাচ্ছে, তাদের ওজন, উচ্চতা বাড়ছে কি না এগুলো শিক্ষকরা যাচাই করেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নামের পাশে এই তথ্যগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের বিষয়ে মিষ্টি বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম শেখানো হয়। ১৫ দিন পরপর শিশুদের হাতের নখ বড় হয়েছে কি না সেটা খেয়াল করা হয়। যাদের নখ বেড়ে গেছে তাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে নেইল কাটার দিয়ে নখ কাটা হয়। যারা পারে না তাদের নখ শিক্ষকরাই কেটে দেন। এরপর খাবার আগে, খাবার পরে এবং টয়লেট ব্যবহার করে কীভাবে হাত ধুতে হয় সেটাও শেখানো হয় শিশুদের। শিশুদের নখ, হাত পরিষ্কার রাখলে প্রতি সপ্তাহে কলম, খাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের উপহার দিয়ে তাদের উৎসাহ দেন শিক্ষকরা। তানজিনা নাজনীন মিষ্টি বলেন, আমার স্বপ্নের সবটুকু জায়গা জুড়ে এই বিদ্যালয়। শুধু শিক্ষা নয় মনন-মানসিকতায় উদার মনের মানুষ হিসেবে জাতির ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলায় একজন শিক্ষক হিসেবে আমার লক্ষ্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর