শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মেঘ-পাহাড়ের শহরে

পান্থ আফজাল

মেঘ-পাহাড়ের শহরে

দার্জিলিং চষে বেড়ানোর এ যাত্রাটা ছিল বাই রোডে। ঢাকা থেকে চ্যাঙরাবান্ধা বর্ডার দিয়ে শিলিগুড়ি। আর শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং মাত্র ৮০ কি.মি.। যেতে হয় জিপে চড়ে। একাই ছিলাম। দল ভারি হলে অবশ্য জিপ রিজার্ভ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেতে যেতে চলতি পথে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় মেঘেদের সঙ্গে সখ্য হবে, ভাগ্য ভালো থাকলে মেঘেরা এসে ছুঁয়েও দিয়ে যেতে পারে আপনাকে। রাত ৮টার পর দার্জিলিংয়ের হোটেল, দোকান-পাটসহ প্রায় সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। তাই দার্জিলিং-এ যাওয়ার প্ল্যান থাকলে আগে থেকে হোটেল বুকিং দেওয়াই ভালো। কার্সিয়াং পর্যন্ত যেতে যেতে সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড় আর রাস্তাঘাটের সৌন্দর্য যে কোনো আনাড়ি পর্যটককেও মুগ্ধ করবে। প্রকৃতি তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে সাজিয়েছে দার্জিলিংকে। কার্সিয়াং, ঘুম শহর পার হয়ে দার্জিলিং  যেতে জিপ থেকে চোখে পড়ে দূরের সারি সারি ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা সাদা কালো মেঘ আর কুয়াশা মিলেমিশে যেন একাকার। এমন সৌন্দর্যে অবগাহন করতে সে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে থাকা ওক গাছের ছায়ার আলিঙ্গনে তৈরি মনোরম ঘরবাড়ি যেন সভ্যতার এক অপূর্ব বিনির্মাণ। সর্পিল রাস্তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরই চোখে পড়বে রেললাইন। ইচ্ছে করলে টয় ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে পারবেন। ‘নেপালি ছেলের হাতেও গিটার থাকে, তার সুর ঘোরে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে’-গানে গানে এভাবেই দার্জিলিংয়ের ছবি এঁকেছেন আমাদের বাংলা গানের শিল্পী কবীর সুমন। এ যেন স্বর্গীয় এক শহর! আমাদের দেশে যখন শীত পড়তে শুরু করে দার্জিলিংয়ে তখন পড়ে বরফ। পাহাড়ের ওপর উঠলে মনে হয় যেন মেঘের দেশে এসেছি। সোনায় মোড়া কাঞ্চনজংঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে বোধ হয় এর চেয়ে ভালো আর কোনো স্থান নেই। তাই বিদেশ ভ্রমণে দার্জিলিং বরাবরই সৌন্দর্য পিপাসুদের প্রথম পছন্দ। জিপ থেকে নেমেই হোটেল নিলাম দার্জিলিং রেল স্টেশনের কাছেই। দার্জিলিং পুরো শহরটাই যেহেতু পাহাড়ের ওপরে, সেহেতু ভালো হয় মাঝামাঝি জায়গায় ম্যাল রোডের (মূল সড়ক) আশপাশে হোটেল বাছাই করা। কারণ, বেশি ওপরের দিকে হলে নিচে নামতে অসুবিধে হয়, আবার নিচের দিকে হলে পুরো শহরের ভিউটা তেমন করে নজরে পড়বে না। আর প্রত্যেক হোটেলে গরম পানি আর ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা থাকে। খাবারের ব্যবস্থাও হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে করে নিতে পারবেন। দার্জিলিং-এ পৌঁছেই প্ল্যান ছিল পুরো শহরটা ঘুরে দেখার। বের হলাম মুসলিম হোটেলের উদ্দেশ্যে। বড় মসজিদের পাশে দুটি মুসলিম খাবার হোটেল আছে। একটা বড় আরেকটা ছোট। ছোটটায় দাম কম। খাবারও খুব ভালো। হেঁটে পুরো শহরটাকে চক্কর দিলে অনেক কিছুই নজরে পড়বে। ছবির মতো শহর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা পেলাম সেন্ট জোসেফ স্কুলের। যেখানে শাহরুখ খানের মুভিসহ বেশ কিছু হিন্দি মুভির শুটিং হয়েছিল। এর ভিতরে ঢোকা নিষেধ, তাই বাইরে থেকেই দেখলাম; সঙ্গে বোনাস কিছু সেলফি।

 

এ স্থান থেকে কাঞ্চনজংঘা স্পষ্ট দেখা যায়। শহরের মানুষগুলো খুবই আন্তরিক আর মিশুক। গাড়ির চালকরাও খুব ভালো। বিনা কারণে কেউ হর্ন বাজায় না, যেখানে সেখানে পার্কিং করে যানজট সৃষ্টি করে না, চলতি পথে হাতের ইশারায় একে অন্যের ভালো মন্দের খোঁজ খবরও নেয়। দার্জিলিংয়ের বেশির ভাগ মানুষই নেপালি আর ভাষা নেপালি, হিন্দি। ধর্ম হিসেবে বেশির ভাগ বৌদ্ধ, এরপর হিন্দু এবং অল্প সংখ্যক মুসলমান। সারা বছরই শীত থাকে এখানে। ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারিতে অল্প তুষারপাত হয়। এ সময় তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি ক্রমানুসারে নেমে আসে। জানুয়ারি মাসে তুষারপাতের দরুন খুব বেশি ঠাণ্ডা থাকে, সবখানে জমে থাকে সাদা বরফের স্তর। দার্জিলিং বেড়ানোর জন্য দুটি সময় সবচেয়ে ভালো, মার্চ থেকে জুনের শেষ এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। হোটেলের কাছেই দার্জিলিং রেল স্টেশন। সেখানে গিয়ে টয় ট্রেনে চেপে বসলুম। এটি চক্রাকারে বাতাসি লুপ হয়ে ঘুম ষ্টেশন ঘুরে আবার দার্জিলিং স্টেশনে ফিরে আসে। এখান থেকে পুরো দার্জিলিংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য চোখের সামনে ধরা দেবে। অদ্ভুত সৌন্দর্যের আধার এই দার্জিলিং! সবুজে আচ্ছাদিত উঁচু-নিচু পাহাড় ভেদ করে বেড়িয়ে যাওয়া সাপের মতো রাস্তা আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে চলা রেললাইন দার্জিলিংকে দিয়েছে আলাদা বৈচিত্র্যতা; দার্জিলিংয়ের প্রতিটি বাঁক যেন অষ্টাদশী তরুণীর নির্লিপ্ত চাহনি, শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ডুবে যেতে মন চাইবে। পাহাড়ের কথোপকথনের শব্দরাশি আর শত-সহস্র অভিমানী পাহাড়ি মুখশ্রীর আলিঙ্গন পাবেন দার্জিলিংজুড়ে। যেন নিজেকে উজাড় করে রাখা এক প্রিয়তম প্রেমিকার অপর নাম দার্জিলিং। এই ঠান্ডার শহরে চা বাদে প্রায় সবই আসে শিলিগুড়ি থেকে! হালকা কিছু মসলা, সবজি চাষ হয়ে থাকে। পর্যটন নগরী বলে বেশির ভাগ মানুষ রেস্টুরেন্ট, হোটেল ব্যবসা আর পর্যটক ঘুরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পরের দিন রাত ৩টায় ঘুম থেকে উঠে হোটেলের গাড়িতে রিজার্ভে টাইগার হিলের উদ্দেশে রওনা। সূর্যোদয়ের হাসির চিকিমিকি দেখা যায় হিমালয়ের বরফ ছুঁয়ে। সারা দিনে প্রায় ১৫টি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় টাইগার হিল আর গঙ্গামাইয়া পার্ক। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখে আসার পথে দেখা যায় স্যামটেন চোলিং বুদ্ধিষ্ট মনাস্টি। পুরনো এই মন্দিরটিতে অনেকেই আসে মানত নিয়ে। সময় নিয়ে দার্জিলিং ঘুরে দেখা যায় জাপানিজ ট্যাম্পল, পিস প্যাগোডা, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম স্টেশন, জাদুঘর, কাউন্সিলর হাউস, এভা আর্ট গ্যালারি, ধরধাম টেম্পল আর দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পয়েন্টস গঙ্গামাইয়া পার্ক ও গার্ডেন রক। চিড়িয়াখানা ও হিমালয়ান মাউন্টেইরিং রোপওয়ে এবং চা বাগানে ঘুরতে ভালোই লাগবে। দড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারেন ১১০ ফুটের তেনজিং রক। মল থেকে পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় নাইটিংগেল পার্কে। প্রায় ৭০০০ ফুট উপরে অবস্থিত এই পার্কে আছে শিব মন্দির, কৃত্রিম ঝর্ণা, পিকনিক স্পট। দার্জিলিং শহর থেকে খানিকটা দূরে শহর কাঞ্চনজংঘা, যেখানে প্যারাগ্লাইডিং করা যায়। চাইলে ছোট্ট শহর মিরিক ঘুরে আসতে পারেন। থাকাও যায়। মিরিক থেকে শিলিগুড়ি কাছাকাছি। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে দার্জিলিং-এ থাকার পুরো ৪ দিন কী এক অদ্ভুত ভালোলাগায় যেন বুঁদ হয়ে ছিলাম!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর