শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ডা. সুসানে গীতি

দেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল

ছবি : জয়ীতা রায়

পদ্মাপাড়ের শান্তির শহর রাজশাহীর ছায়া ঘেরা নির্মল পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। ধরনীর বুকে কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হতেই নানা নাম রেখেছিলেন ‘সাউসান-ই গীতি’। ফার্সি শব্দ ‘সাউসান-ই গীতি’র বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘পৃথিবীর ফুল’। সৌরভ আর পবিত্রতার বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে তার আগমন। কিন্তু শিক্ষাজীবনে নিবন্ধনের সময় ভুল করে নাম হয়ে যায় ‘সুসানে গীতি’। শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন প্রতিটি দায়িত্ব। কর্মগুণে এই বিজয়িনী নারী সফলতার সোপানে যুক্ত করেছেন নতুন এক পালক। বলছিলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম নারী মেজর জেনারেল ডা. সুসানে গীতির কথা।

 

গত ৩০ সেপ্টেম্বর মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান তিনি। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সামছুল হক ওইদিন সেনা সদর দফতরে তাকে মেজর জেনারেল পদবির র‌্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন। তার স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুল্লাহ মো. হোসেন সাদ (অবসরপ্রাপ্ত) একজন সফল সামরিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। মেজর জেনারেল সুসানে গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী ডাক্তার হিসেবে ক্যাপ্টেন পদবিতে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই অর্জনের অনুভূতি বিষয়ে তিনি বলেন, যে কোনো নতুন কিছু শুরু করার মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ থাকে। আমাকে দিয়ে যখন এই যাত্রা শুরু হয় সেই অনুভূতি সত্যিই অভাবনীয়। মেজর জেনারেল পদে প্রথম নারী হিসেবে পদোন্নতি নারীর ক্ষমতায়নে নতুন অর্জন হিসেবে যুক্ত হলো। কাজের ক্ষেত্রে সব দায়িত্ব কোনো ছাড় না দিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পালনের চেষ্টা করেছি। স্বপ্নগুলো সময়ের স্রোতে এখন সত্যি হয়ে ধরা দিচ্ছে। শৈশব এবং কৈশোরের বেড়ে ওঠার কথা জানতে চাইলে স্মৃতি হাতড়ে পুরনো দিনে ফিরে যান তিনি। আনত চোখে মিষ্টি হেসে বলেন, আমার জন্ম, শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্যের প্রতিটি সময়ের সাক্ষী রাজশাহী।

আমার দাদার বাড়ি দিনাজপুরে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে আমরা রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বাস করতাম। আমার জন্মও রাজশাহীতে। শহরের প্রাণকেন্দ্র সোনাদীঘির মোড়ে আমাদের বাড়ি। রাজশাহীর পিএন গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং রাজশাহী গভ. কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৫ সালে এমবিবিএস শেষ করি। সেনাবাহিনীতে কি নিজের পছন্দে আসা নাকি জীবনের তাগিদে জানতে চাইলে বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সুশৃঙ্খল জীবন আমার আগে থেকেই পছন্দ ছিল।

কর্তব্যবোধ দেশপ্রেম আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সময় আমাদের পরিচালক ছিলেন একজন সেনাকর্মকর্তা। তিনি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে কলেজ পরিচালনা করতেন। প্রতিটা কাজ গুছিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতেন। এই বিষয়গুলো আমার মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। তখন ইন্টার্নশিপের আবেদন করি। পরবর্তীতে নিজের পছন্দের জায়গা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আমার কাজের সুযোগ তৈরি হয়। নারীদের বর্তমান অবস্থান বিষয়ে মেজর জেনারেল ডা. সুসানে গীতি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের নারীরা। শিক্ষিত মা শিক্ষিত সমাজ উপহার দেবেন। শিক্ষিত সমাজের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। সশস্ত্র বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তরুণ শিক্ষিত নারীরা এগিয়ে আসছে। তারা সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি পেয়ে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের এই অগ্রযাত্রায় আমরা গর্বিত।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সমাজের সব ক্ষেত্রের পাশাপাশি নারী ক্ষমতায়নে অর্জিত হয়েছে বিস্ময়কর সাফল্য। জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে নারীরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। তবে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা বিভেদ রয়েছে, সেদিক থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতে ব্যবস্থাটিই অন্য রকম। আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তা আমাকেই পালন করতে হবে। নারী-পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই। সেটাই আমরা চেষ্টা করি সুচারু রূপে পালন করার। সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে অনেক আগে থেকেই ডাক্তার আছেন। কর্নেল রোকেয়া আনিস ম্যাডাম ছিলেন। ওই কোরের প্রথম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন সুরাইয়া রহমান। ভবিষ্যতে আমরা আরও এগিয়ে যাব।

 

সেক্ষেত্রে কি আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি যে আগামীতে সেনাপ্রধান হতে যাচ্ছেন একজন নারী- এমন প্রশ্নে অনেকটা অট্টহাসি দিয়ে তিনি বলেন, হতেও পারে। অসম্ভব কী? কারণ আমাদের অন্যান্য কোরেও তো আর্মিতে নারীরা এসেছেন। মেজর জেনারেল হওয়ার পর কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন প্রশ্নে তিনি জানান, মানুষ যত ওপরে উঠবে তার দায়িত্বও তত বাড়বে। আমার কাছে এখন বড় দায়িত্ব হচ্ছে পেশাগত জ্ঞান দিয়ে সেবার মান আরও উন্নত করা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালনকালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশকে সবাই ভীষণ পছন্দ করে। কারণ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। প্রতি বছর সেখানেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ব্যানমেডে আমরা মেডিকেল কোর থেকে প্রথম গিয়েছিলাম। একটা কন্টিনজেন্টে নারী হিসেবে আমরা প্রথম গিয়েছিলাম। ব্যানমেডে ওরা বাংলাদেশকে খুব পছন্দ করত। আমরা একটা ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক পরিচালনা করতাম।

গ্রামে গ্রামে গিয়ে ওদের বিভিন্ন অসুখে আমরা সেবা দিতাম। বিপদে আপদে আমাদের পাশে পাওয়ায় বাংলাদেশ ওদের কাছে ভালোবাসার আরেক নাম। তারা আমাদের এত ভালোবাসত যে আমাদের কাছে এসে বাংলা শিখে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করত। বাংলায় গান গেয়েছে তারা। ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জননী তিনি। বড় দুই ছেলে-মেয়েও ডাক্তার। তারা স্পেশালাইজেশন কোর্সে রয়েছে। সবার ছোট মেয়েটি পড়াশোনা করছে উচ্চমাধ্যমিকে। নতুন প্রজন্মের জন্য তার পরামর্শ জানতে চাইলে বলেন, বি ডেডিকেটেড টু ইওর সার্ভিস। মানুষের সেবা হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। চিকিৎসক হিসেবে বলব- রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

মেলেনি বীর শহীদ বাবার লাশ

১৯৭১ সাল। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। বাবা রাজশাহীতে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও ঘাঁটি গেড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। এক দিন বাবাকে ডেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না। অপেক্ষার প্রহর ভাঙলে জানতে পারি আমার বাবা খলিলুর রহমান আর নেই। তাকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনারা। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে শুরু করে বদ্ধভূমিতেও খোঁজ করি আমরা। কিন্তু মেলেনি বাবার লাশ। জানি না কোথায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমার বাবা। তাই বাবার রক্তে ভেজা এ মাটি আমার কাছে খুব আবেগের। শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে দেশের প্রতি ত্যাগ এবং অনুভূতির জায়গাটা অন্যরকম, অনেক গভীর।

সর্বশেষ খবর