শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

তনিমার বিশ্বজয়

রচনা লিখে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে

আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

তনিমার বিশ্বজয়

জঙ্গিদের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে ইংরেজিতে রচনা লিখে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যোগদানের সুযোগ পেয়েছেন কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার অজপাড়া গায়ের এক শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয়, সাধারণ অধিবেশনের একটি সেশনে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে আজকের যুব সমাজের ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে ভাষণ  দেওয়ার সুযোগও পেয়েছেন এই শিক্ষার্থী। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘের সদর দফতরে বাংলাদেশ সময় রাতে ভাষণ দেন তিনি। পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী মাতবরবাগীর নাতনি ও পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী তনিমা আফরোজ শুধু কক্সবাজারের নয়, সারা দেশের যুব সমাজের মুখ উজ্জ্বল করেছেন জাতিসংঘের অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে। তার ভাষণের সময় সাধারণ অধিবেশনের ওই সেশনে বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান উপস্থিত ছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক পড়–য়া তনিমার ইংরেজিতে দেওয়া ভাষণ অনেক দেশের মন্ত্রীরা মনোযোগ দিয়ে  শোনেন। দেশের অখ্যাত এক কলেজে পড়–য়া তনিমা জাতিসংঘের অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। তনিমা সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়া ছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

 

বেড়ে ওঠা

অভাবের সংসার, নানাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা। শৈশবে অনেকটা বঞ্চিত পিতা-মাতার ¯েœহ থেকে। তার মেধা শ্রম আর অধ্যাবসায় যেন সবকিছুকে পেছনে ফেলে তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। একসময় যারা অবহেলা করত তারাও আজ তনিমাকে নিয়ে গর্ব করে। পেকুয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ‘এ’ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হন এসএসসি পরীক্ষায়। পরে উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজে।

 

জাতিসংঘে যাওয়ার সুযোগ

সম্প্র্রতি দেশে ও বিদেশে আকস্মিক জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন এনজিওতে কাজ শুরু করেন জঙ্গিবাদের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে। তেমনি একটি এনজিও হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতায় কোডেক ‘তরুণ আলো’ প্রকল্প ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ‘উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ’ বিষয়ে দেশব্যাপী ইংরেজিতে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় । যার শিরোনাম ছিল (What I have done to prevent violent extremism in our community ) । দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা প্রায় ৮টি এনজিওর মাধ্যমে অনেক ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। কোডেক তরুণ আলো প্রকল্পের আওতায় অংশ নেন পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী তনিমা আফরোজ। প্রতিযোগীদের খাতা মূল্যায়ন করা হয় সুইজারল্যান্ডে। যেখানে প্রায় ৬০ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দেশসেরা হন তনিমা আফরোজ। ফলে তার ডাক পড়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে। তার এই বিচক্ষণ মনোভাব জঙ্গিমুক্ত বিশ্ব গড়ার স্বপ্নকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয় তাকে। জাতিসংঘে ডাক পড়ার খবরে অবাক হন তনিমাসহ সহপাঠী ও তার শিক্ষকরা। তনিমা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তাকে সবাই শুভেচ্ছা জানান। তাকে নিয়ে গর্বিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ তার পরিবার। এই সাফল্যে তিনি তার নানা এবং কোডেক তরুণ আলোকে অভিনন্দন জানান। এ ব্যাপারে পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সুদক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী ও কলেজ কতৃপর্ক্ষের তত্ত্বাবধানে এবং এনজিও কোডেক তরুণ আলো প্রকল্পের সহযোগিতায় সে জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করছে শুনে আমরা খুবই আনন্দিত। শিক্ষা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ে সুনাম অর্জনকারী আমাদের কলেজের ব্যাপারে সরকারের আরও সুদৃষ্টি কামনা করছি। তনিমাকে তত্ত্বাবধানকারী শিক্ষক ইংরেজি প্রভাষক মোহাম্মদ আলম বলেন, ইংরেজি শিক্ষা ও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে আমি তাকে সহযোগিতা করেছি, সেও ভালো করেছে। শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, আসলে মেয়েটা খুবই আগ্রহী, সে আরও ভালো করবে আশা করছি। কোডেক তরুণ আলো প্রকল্পের পেকুয়া উপজেলার ফিল্ড অফিসার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমি কলেজে প্রতি মাসে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের কুফল বিষয়ে একটি করে ক্লাস নিয়ে থাকি । এতে তনিমার আগ্রহ দেখে আমি তাকে এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দিই। আমি তার সফলতা কামনা করছি। 

 

আমেরিকায় যা করলেন তনিমা

‘আমি গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে কাতার এয়ারলাইনস হয়ে নিউইয়র্ক গমন করি। নিউইয়র্কের দ্য রোজ বেল্ট হোটেলে উঠি। সেখান থেকে ২৬  সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ে বক্তব্য রাখি। আমি অন্ধকার পথ থেকে আমার গ্রামের রাকিব নামে এক যুবককে আলোর পথে ফিরিয়ে আনি। জঙ্গিবাদের স্থান যে কোথাও নেই, এটা যে কোনো ধর্মই সমর্থন করে না তা  বোঝাতে সক্ষম হই এবং তাকে এই অন্ধকার পথ থেকে ফিরিয়ে আনি। এই বিষয় নিয়ে আমি বক্তব্য রাখছিলাম, তারা আমাকে প্রশ্ন করলেন কেন আমি এ পথে আসলাম? তাদের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, কোডেক তরুণ আলো নামের একটি এনজিও সংস্থা কলেজে এসে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে ক্লাসে আলোচনা করল। সেখান থেকে আমি মনে মনে ঠিক করলাম আমি এ বিষয় নিয়ে সমাজে কাজ করব। তখন থেকে আমি এ বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করি এবং রাকিবকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হই। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারপ্রধানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে এ ব্যাপারে ধন্যবাদ জানান। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখা আমার জন্য পুরোটাই ছিল স্বপ্নের মতো। তবে আমার জন্য এটা ছিল জীবনের বড় রকমের অভিজ্ঞতা। আমি হয়তো জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়ার সুযোগ না পেলে তা উপলব্ধি করতে পারতাম না। আমাকে যে কয়টি প্রশ্ন করা হয়েছিল সবকটির বিষয় ছিল কীভাবে আমি একজন বিপদগামী যুবককে আলোর পথে ফেরালাম। আমি বলতে চাই, কোনো ধর্মই সত্যিকার অর্থে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে এসব হত্যাকান্ড চালান তারা আসলেই অপব্যাখ্যায় ডুবে আছে। তাদের বুঝিয়ে আলোর পথে আনতে হবে। তবে সে দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। আমি যেটা মনে করি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ে সবার আগে কাজ করতে হবে যুব সমাজকে। যুব সমাজের সচেতনতা ছাড়া আমি মনে করি জঙ্গিবাদ রোধ করা সম্ভব নয়। আমি একজন মেয়ে হয়ে যেটা অনুভব করি তা হলো আমি অবাক হলাম সবাই আমাকে উৎসাহ দিতে লাগল, প্রথমে আমি আসলেই নার্ভাস ছিলাম। তবে আমি সত্যি অবাক হলাম এত দূর আসা যাওয়া এত বড় বিষয় নিয়ে কাজ করা আমার ফ্যামিলি, আমার কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার ও আমার সব শিক্ষক, আমার সহপাঠীরা যেভাবে উৎসাহ দিতে লাগল সত্যিই আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে আমার এতটুকু যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি হলেন আমার কলেজের  ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মো. আলম। আমি উনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আগামীর বিশ্বটা একটি নিরাপদ বাসভূমি দেখতে চাই, যেখানে উগ্রবাদের কোনো ঠাঁই নাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর