শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নীল জলরাশিতে সম্পদের হাতছানি

জিন্নাতুন নূর

নীল জলরাশিতে সম্পদের হাতছানি

বঙ্গোপসাগরজুড়ে বিস্তৃত নীল জলরাশি। সাগরের সেই নোনা জল ঘিরে হাতছানি দিচ্ছে বিপুল সামুদ্রিক সম্পদ। আর সেই সম্পদ ঘিরে তৈরি হয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সমুদ্রের সেই অর্থনীতি হচ্ছে ‘ব্ল- ইকোনমি’কে ঘিরে। বিশাল সাগরজুড়ে বাংলাদেশের সম্পদ আহরণের যে সুবর্ণ সুযোগ তা যথাযথভাবে পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা হলে দেশের অর্থনীতি আগামী দিনে আরও সমৃদ্ধ হবে এমনটিই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ব্লু-ইকোনমি নিয়ে সরকারের করা বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, শুধু সমুদ্র থেকেই ২৬টি অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মৎস্য শিকার, সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং শিপিং, জ্বালানি, ট্যুরিজম, কোস্টাল  প্রোটেকশন, মেরিটাইম মনিটরিং জরিপ ইত্যাদি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে সম্পদ আহরণে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতি করেছে। আবার বেশ কিছু খাত ঘিরে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনাও। যেমন- বর্তমানে বিশ্বের ৫০-৬০% ইলিশ মাছই বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকা থেকে আহরণ করা হচ্ছে। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৫৬৮ মেট্রিক টন টাইগার শ্রিম্প বঙ্গোপসাগর থেকে ধরা হয় যার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের মধ্যে বড় আকারের কাঁকড়া ও সামুদ্রিক এলমাছও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। অর্থাৎ সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং এই মাছ বহির্বিশ্বে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এরই মধ্যে সমুদ্রের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য ক্রয় করা হয়েছে বেশ কয়েকটি জলযান। সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রাণী আহরণ এবং গবেষণায় ক্রয় করা হয়েছে গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’। ব্লু-ইকোনমি সেলের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’র মাধ্যমে ২০১৬ -এর শেষ দিক থেকে সমুদ্রে মৎস্য সম্পদের জরিপকাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ৪টি ক্রুজের মাধ্যমে ১৭৬ প্রজাতির মৎস্য, ১৩ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪টি অন্য প্রজাতির ক্রাস্টাসিয়ান ও মোলাস্ক চিহ্নিত করা হয়েছে। আগামী ২০১৯-এর জুনে এর জরিপকাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া গবেষণা জাহাজ আর.ভ. ডা ফিটজফ ন্যানসেন-এর মাধ্যমে সমুদ্রাঞ্চলে মৎস্য সম্পদের ওপর অ্যাকুয়াস্টিক সার্ভে পরিচালনা শিগগিরই শুরু করা হবে। এমনকি শিগগিরই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন কূপ খনন করার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ এই চার দেশের সমন্বয়ে সিক্রুজ বা কোস্টাল ট্যুরিজমের ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক কোর্স চালু করা হয়েছে। আর সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক জাহাজ ও হেলিকপ্টারও সংযোজন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সমুদ্রের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতায় সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে জরিপ জাহাজ ভাড়া করার জন্য এক্সপ্রেশন অব ইনটেরেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৩টি প্রস্তাবের মূল্যায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া সমুদ্রাঞ্চলে নন-এক্সক্লুসিভ মাল্টি-কায়েন্ট ২ডি সিসমিক সার্ভের বিষয়টিও বর্তমানে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি সম্পন্ন হলে জরিপ জাহাজ ভাড়া করার আর প্রয়োজন হবে না। এরই মধ্যে সাগরের ব্লক এসএস-০৪-এ ১টি অনুসন্ধান কূপ খননের কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর ব্লক এসএস-১১-এ স্যান্টোস কর্তৃক থ্রিডি সিসমিক সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর মার্চের মধ্যে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ডিএস-১২-এ ফসকো ডাইয়ু করপোরেশন কর্তৃক চলতি বছরের নভেম্বরে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করার কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। এমনকি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ আহরণ ইত্যাদির জন্য দক্ষ জনবল তৈরির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য স্বল্প, মধ্যম মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্স -এর জনবল দক্ষতা বৃদ্ধিতে ৪৫৫ জনকে বিদেশে এবং ৩৫৯৬ জনকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে প্রতি বছর নটিক্যাল, মেরিন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফিশ প্রসেসিং বিষয়ে ৮০ জন দক্ষ জনবল তৈরি করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সমুদ্রের সম্পদ রক্ষায় কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথম ব্যাচের ২টি জাহাজ গত বছর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কমিশনিং করা হয়। আর দ্বিতীয় ব্যাচের ২টি জাহাজেরও কমিশনিং করার কথা রয়েছে। একই উদ্দেশ্যে শিগগিরই ৪টি হেলিকপ্টারও কোস্টগার্ডে সংযুক্ত হওয়ার কথা। এ ছাড়া সমুদ্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা ও অবৈধ ট্রলার অনুপ্রবেশ রোধে বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোকে স্থলভাগ থেকে মনিটর করার জন্য ১৩৩টি ট্রলারে ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম সংযোজন করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে ৯টি লং লাইনার এবং ৭টি পার্স সেইনার জাতীয় মৎস্য নৌযানের অনুমতিপত্র প্রদান করা হয়েছে। আর গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে সমুদ্র সম্পদ রায় এবং সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকা ও গভীর সমুদ্র এলাকায় নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সমুদ্রগামী জলযান সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে চারটি অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল দেশে এসেছে। আরও ৭টি ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল নির্মাণাধীন রয়েছে। আর ৮টি আনম্যানড এরিয়াল ভেসেল ও ৪টি হোভার ক্রাফট ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীও সমুদ্র সংলগ্ন নদী/মোহনাসমূহে জরিপ কাজের জন্য ৪টি জাহাজ তৈরি করছে। যা বর্তমানে নির্মাণাধীন আছে। এ ছাড়া চীনের নৌবাহিনী থেকে ২টি ফ্রিগেট ক্রয়ের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই চার দেশের সমন্বয়ে সিক্রুজ বা কোস্টাল ট্যুরিজমের ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ক কোর্স চালু করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর