শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বনদস্যু থেকে সুস্থ জীবনে

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

বনদস্যু থেকে সুস্থ জীবনে

আত্মসমর্পণকৃত মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার ও মানজুর বাহিনীর প্রধান মানজুর সরকার

সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ২৯টি বনদস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণের পর ম্যানগ্রোভ এই বনে বইছে শান্তির সুবাতাস। পড়ছে না কোনো লাশ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বনদস্যুদের সব ঘাঁটি। বনদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই বনের জীববৈচিত্র্য। জেলে-বনজীবীদের মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ বাণিজ্য এবং দেশি-বিদেশি চোরাকারবারিদের চাহিদামতো হরিণ, বাঘ-কুমির শিকার ও পাচার প্রায় বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম লবণাক্ত জলাভূমির হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির ও কিংকোবরাও হাফছেড়ে বেঁচেছে। সুন্দরবনে এখন থেকে-থেকে শোনা যায় না গুলির শব্দ। বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। সুন্দরবনে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দেশি-বিদেশি ইকোট্যুরিষ্টের সংখ্যা বাড়ছে। সুন্দরবন ফিরে পেয়েছে তার প্রাণ। এদিকে বনদস্যু বাহিনীর ২৭৪ সদস্য আত্মসমর্পণের পর সরকারিভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে আত্মসমর্পণ করা সব বনদস্যু বাহিনীর সদস্য। এখন পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন, যা এক সময় ছিল তাদের কল্পনারও বাইরে। তাদের আর পেছনের দস্যু জীবন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে তারা সমাজের মূলশ্রোতধারায় মিশে গেছেন। তবে, সুন্দরবন এখনো পুরোপুরি বনদস্যুমুক্ত হয়নি। বনদস্যু সাত্তার ও শরিফ বাহিনীর নামে ছোট দুটি বাহিনী মাঝে-মধ্যে তাদের তৎপরতা চালায়। এ দুটি বাহিনীও সহসা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে বলে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু বাহিনীর একাধিক প্রধান জানিয়েছেন।

 

সুন্দরবনের বনদস্যুতা

সুন্দরবনের বাঘ-কুমিরের চেয়েও জেলে-বনজীবীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম বনদস্যু। সুন্দরবন সুরক্ষায় বাগেরহাটের পূর্ব বিভাগ চাঁদপাই ও শরণখোলা এবং খুলনা পশ্চিম বিভাগের নলিয়ান ও বুড়িগোয়ালিনী এই ৪টি রেঞ্জের অধীনে রয়েছে ১৮টি ফরেষ্ট স্টেশন ও ৫৬টি টহল ফাঁড়ি। গোটা সুন্দরবনের দেখভালের জন্য রয়েছেন মাত্র ৮৮৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, লোকবল সংকটসহ দ্রুতগতির জলযান, আধুনিক অস্ত্রের অভাবে বনরক্ষীরা নিজেরাই থাকতেন সবসময় বনদস্যু আতঙ্কে। এ অবস্থার মধ্যে ১৯৮৭ সাল থেকেই সুন্দরবনে বাড়তে থাকে বনদস্যুদের তৎপরতা। ওই সময় কবিরাজ বাহিনী সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। পরে জেলে ও মৎস্যজীবী নেতাদের প্রতিরোধের মুখে বাহিনীর সদস্যসহ কবিরাজকে প্রাণ হারাতে হয়। এর পরও থেমে থাকেনি বনদস্যু বাহিনীর উত্থান। লোকালয়ের প্রভাবশালী গডফাদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নতুন-নতুন নামে বনদস্যুবাহিনী গঠন করে সন্ত্রাসীরা সুন্দরবনসহ উপকূলের জেলে-বনজীবীদের টার্গেট করে নেমে পড়ে মুক্তিপণের দাবিতে ‘বিনা পুঁজির ব্যবসা’ অপহরণ বাণিজ্যে। এ ছাড়াও আন্ডারওয়ার্ল্ডে বাঘ-কুমিরসহ বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার বাণিজ্যও রয়েছে। বনদস্যুদের প্রধান খাবার ছিল হরিণ। সুন্দরবনে এমন পরিস্থিতিতে অপ্রতিরোধ্য বনদস্যু বাহিনীগুলোকে দমনে পুলিশ, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যরা চালাতে থাকেন অভিযান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয় বাহিনীপ্রধানসহ অনেক বনদস্যু। আটক বনদস্যুরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে ফিরে যায় আবার পুরনো পেশায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়তে থাকে অনেক বাহিনীপ্রধানসহ বনদস্যুরা। উদ্ধার হয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ। এক-একটি বনদস্যু বাহিনীপ্রধান বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর ওই বাহিনীর সদস্যরা আন্তকোন্দলে নতুন নামে একাধিক বাহিনী গড়ে তুলে সুন্দরবনে নেমে পড়ে। সৃষ্টি হতে থাকে নতুন-নতুন বনদস্যু বাহিনী। এক-একটি বনদস্যু বাহিনী সুন্দরবনের এক-একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লোকালয় থেকে তাদের গডফাদারদের পাঠানো খাদ্য-পানি, অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রেখে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তুলে চালাতে থাকে ফিশিং ট্রলার ও নৌকাসহ জেলে-বনজীবীদের অপহরণ। জেলে-বনজীবীদের আটক করে তাদের নির্যাতনের শব্দ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অপহƒতদের স্বজনদের শুনিয়ে হাতিয়ে নিতে থাকে মোটা অঙ্কের টাকা। গোটা সুন্দরবন কার্যত বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ

র‌্যাব ও কোস্টগার্ড এমন পরিস্থিতির মধ্যে সুন্দরবনে একাধিক স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে বনদস্যু দমনে শুরু করে অলআউট অভিযান। সুন্দরবনে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। ১৭ বনদস্যু বাহিনী প্রধান ও সেকেন্ড ইন কমান্ডসহ অসংখ্য বনদস্যু মারা যায়। র‌্যাব শক্ত অবস্থান নেওয়ায় বিগত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বনদস্যু বাহিনীপ্রধানদের মধ্যে ‘প্রাণভয়’ পেয়ে বসে। প্রাণ বাঁচাতে সুন্দরবন সন্নিহিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে থাকে সব থেকে বড় বনদস্যু ‘রাজু বাহিনী’র প্রধান রাজুসহ অন্য বাহিনীগুলোর প্রধানরা। এ অবস্থার মধ্যেও সুন্দরবনে থেমে-থেম চলতে থাকে বনদস্যুদের তৎপরতা। প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে বনদস্যু বাহিনীগুলো। বিভিন্ন মাধ্যমে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে বনদস্যু বাহিনীপ্রধানরা। বনদস্যু বাহিনীগুলো কি সত্যিই আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক? এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে নিশ্চিত হয়েই মাঠ পর্যায়ের র‌্যাব কর্মকর্তারা বিষয়টি তাদের হেডকোয়ার্টারের র্শীষ কর্মকর্তাদের জানান। র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ মন্ত্রণালয়ের র্শীষ কর্মকর্তাদের জানান। এরপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ সমুদ্র উপকূলকে ‘দস্যুমুক্ত’ করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত আসে। শুরু হয় মাঠ পর্যায়ে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রাথমিক কাজ। আত্মসমর্পণ করতে এলে বনদস্যুদের মেরে ফেলা হবে না, সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিতে হবে। আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুদের নামে কোনো হত্যা ও ধর্ষণ মামলা না থাকলে আদালতের মাধ্যমে তারা দ্রুত ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। র‌্যাবের কথা আস্থায় নিয়ে সরকারের বিশেষ ক্ষমার আওতায় প্রথমে আত্মসমর্পণে এগিয়ে আসে দুর্র্ধর্ষ বনদস্যু ‘মাস্টার বাহিনী’প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টারসহ তার বাহিনীর সদস্যরা। ২০১৫ সালের ৩১ মে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের ফুয়েল জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫ হাজার রাউন্ড বিভিন্ন প্রকার গোলাবারুদ জমা দিয়ে তার ৯ সহযোগীসহ দুর্র্ধর্ষ বনদস্যু ‘মাস্টার বাহিনী’প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার আত্মসমর্পণ করেন। মাস্টার বাহিনীপ্রধানের আত্মসমর্পণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার ঘটনা অন্যসব বনদস্যু বাহিনীর মধ্যে প্রভাব পড়ে। এরপর র‌্যাব-৮ এর হাত ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে একে একে ২৬টি বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ সুন্দরবনের ২৪৩ জন বনদস্যু ও র‌্যাব-৬ এর হাত ধরে আত্মসমর্পণ করেন ৩টি বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ৩১ জন বনদস্যু। এ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করা সর্বমোট ২৭৪ জন বনদস্যুর ৯০ ভাগের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা ও রামপাল উপজেলায়। আত্মসমর্পণকৃত সব বনদস্যুই এখন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। আত্মসমর্পণ করা উল্লেখযোগ্য বনদস্যু বাহিনীগুলোর প্রধানরা হচ্ছেন মাস্টার বাহিনীপ্রধান মোস্তফা শেখ, মানজার বাহিনীপ্রধান মানজার সরদার, মজিদ বাহিনীপ্রধান তাকবির বাগচী মজিদ, বড় ভাই বাহিনীপ্রধান আবদুল ওয়াহেদ মোল্লা, ভাই ভাই বাহিনীপ্রধান মো. ফারুক মোড়ল, সুমন বাহিনীপ্রধান জামাল শরিফ সুমন, দাদা ভাই বাহিনীপ্রধান রাজন, হান্নান বাহিনী প্রধান হান্নান, আমির বাহিনীপ্রধান আমির আলী, মুন্না বাহিনীপ্রধান মুন্না, ছোট শামছু বাহিনীপ্রধান শামসুর রহমান, মানজু বাহিনীপ্রধান মো. মানজু সরদার ও সূর্য বাহিনীপ্রধান সূর্য। এসব বনদস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের পেছনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম ও নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আশিকুর রহমান শ্রাবণ।

 

অস্ত্রের খনি সুন্দরবন

আত্মসমর্পণের আগে সুন্দরবন ছিল অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের খনি। থেকে-থেকে শোনা যেত গুলির শব্দ। বাতাসে ভেসে বেড়াত বারুদের গন্ধ। ২৯টি বনদস্যু বাহিনীর ২৭৪ সদস্য আত্মসমর্পণের সময় এলিট ফোর্স র‌্যাবের হাতে তুলে দেয় থ্রি-নট থ্রি রাইফেল, পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেল ও বন্দুকসহ বিভিন্ন প্রকার ৪০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। আর বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্রের গোলাবারুদ জমা দেয় ১৯ হাজার ১৫৩ রাউন্ড।

 

পুনর্বাসিত আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুরা

আত্মসমর্পণের পর বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকার তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে। এক-একজন বনদস্যুকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১ লাখ, ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে ২০ হাজারসহ সর্বমোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ১টি করে মোবাইল সেট। প্রতিটি ঈদ উৎসবে দেওয়া হয়েছে উপহারসামগ্রী। পুনর্বাসনের এই অর্থ সামান্য হলেও বনদস্যুদের এতে করে কোনো ক্ষোভ নেই।

পরিবার নিয়ে বৈধ উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য সবাই কোমরকষে পরিশ্রম করছেন। কেঊ দিয়েছেন মোটর পার্সের দোকান, কাঠের গোলা, মোটর গ্যারেজ, টি-ষ্টল। অনেকে করছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মৎস্য খামার। আবার অনেকে অটো ও রিকশা-ভ্যান কিনে নিজেই চালাচ্ছেন। কেউ বেকার বসে নেই। র‌্যাবের তদারকিতে থাকায় আত্মসমর্পণকৃত এসব বনদস্যু গ্রামীণ সমাজের উটকো ঝামেলা থেকে অনেকটা মুক্ত রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর