শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভুটানে পাহাড়ি সৌন্দর্যের মায়াজাল

শিমুল মাহমুদ

ভুটানে পাহাড়ি সৌন্দর্যের মায়াজাল

পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার জয়গাঁওয়ে রাজকীয় কারুকার্যময় গেট অতিক্রম করে যখন অন্য প্রান্তে ঢুকলাম তখন ঘড়িতে ২৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ১০টা। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে অভিন্ন স্টাইলের হোটেলবাড়ি। ছিমছাপ পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। ক্যালেন্ডারের ছবির চেয়েও সুন্দর করে সাজানো পরিপাটি চারপাশ। মনে হলো যেন এক অন্য জগতে এসে পৌঁছেছি। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা ছাড়াই সুখী মানুষের আবাসভূমি ভুটানে পৌঁছে গেছি। বিভিন্ন বয়সী ৪৩ সদস্যের এই ভ্রমণ টিমের সবার কাছেই এটি ছিল একেবারে অবিশ্বাস্য। ভুটানের সীমান্ত শহর ফুয়েন্টশোলিং থেকেই আমাদের মুগ্ধতার শুরু। সপ্তাহব্যাপী ভুটানের রাজধানী থিম্পুসহ চারটি শহর ঘুরেও এই মুগ্ধতা ফুরায় না। পরদিন সকালে ভারতের জয়গাঁও ঢুকে আমাদের পাসপোর্টে এক্সিট সিল মারতে হয়। তারপরই আমরা ভুটান প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করি।

মাত্র আট লাখ মানুষের দেশ ভুটান পুরোটাই পাহাড় পরিবেষ্টিত। ভুটানের রাজধানী থিম্পু, শীতকালীন রাজধানী পুনাখা এবং অন্য শহর পারো ঘুরে মনে হলো সর্বত্রই যেন সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্যের মায়াজাল ছড়িয়ে রয়েছে। তারা পাহাড়, নদী, সবুজ উপত্যকা এবং পুরো দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ করেছে কঠোরভাবে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভুটানের অধিবাসীদের সুখের কেন্দ্রে রয়েছেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। নিজেদের লোভের লাগাম থেকে দূরে রেখে সুখী থাকার জাতিগত স্বপ্ন নিয়ে বিকশিত হচ্ছে ভুটান। হয়তো এজন্যই পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে জš§ হলেও গৌতম বুদ্ধের অহিংস বাণী ও শান্তির চর্চায় ভুটানের অধিবাসীরাই বেশি নিবিষ্ট। তারই নিদর্শন হিসেবে ভুটান সরকার রাজধানী থিম্পুতে দেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করেছে। ভুটানিরা মনে করে, দেশের সর্বোচ্চ স্থান থেকে বুদ্ধ তাদের দেখে রাখছেন। দেশকে নিরাপদ রাখছেন। থিম্পু শহরের প্রায় সব প্রান্ত থেকেই বুদ্ধ মূর্তিটি চোখে পড়ে। এটি মহামতী বুদ্ধের সবচেয়ে বড় উপবিষ্ট মূর্তি। ১৬৯ ফুট উঁচু মূর্তিটি প্রায় ১৭ তলা ভবনের সমান। ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ৬০তম জš§বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে রাজধানী থিম্পুর কুয়েসেলফোদরং পাহাড়ে এই বিশাল মূর্তিটি স্থাপন করা হয়। বুদ্ধমূর্তি যে ভবনের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে বুদ্ধের অনুরূপ ১ লাখ ব্রোঞ্জের ছোট মূর্তি রাখা আছে। সেগুলোও সোনায় রাঙানো। খোলা আঙিনার চারপাশে নারী ভাস্কর্যগুলোও বেশ নান্দনিক। এটি ভুটানের প্রধান বৌদ্ধ বিহার। বিহারে ভক্তেরা সার্বক্ষণিক ত্রিপিটক আবৃত্তি করেন। বুদ্ধমূতি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৮৬ কোটি টাকা। আর পুরো প্রকল্পে খরচ প্রায় ৮২১ কোটি টাকা। এখনো এ প্রকল্পের কাজ চলছে। আমরা ভবনের ভিতরে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য ধ্যানমগ্ন হই। 

ভুটান সবুজ পাহাড়ি সৌন্দর্যের মায়াজাল ছড়ানো এক চমৎকার জনপদ। পাহাড়ের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে সবুজ সৌন্দর্য এবং ভুটানিদের আলাদা ধাঁচের বাড়িগুলো যেন সৌন্দর্যকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভুটানে মূলত তিনটা শহর ট্যুরিস্টদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজধানী থিম্পু, পুনাখা ও পারো। ছোট শহর ফুয়েন্টশোলিংও কম নয়। আমাদের বাহন হিসেবে দুটি কোস্টার ও একটি কার পুরো সময় সঙ্গী ছিল। হোটেলও বুক করা ছিল আগে থেকেই। ফলে এত বড় টিমের সদস্য হয়ে এত স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করা গেছে। ভুটানের রাজধানী থিম্পু ফুয়েন্টশোলিং থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে। ফুয়েন্টশোলিং মূলত নিচু শহর আর থিম্পু উঁচু শহর। সেজন্য যাত্রা শুরু করে আস্তে আস্তে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় উঠতে হয়েছে। পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা মাঝে একবার চা বিরতি দিয়ে যখন থিম্পুতে পৌঁছলাম তখন মনে হলো মায়াবী কোনো শহরে প্রবেশ করেছি, সবগুলো বিল্ডিং একই প্যাটার্নের। থিম্পু শহরের চারপাশেই উঁচু উঁচু পাহাড় যা থিম্পু শহরটাকে ভিন্ন একটা মাত্রা দিয়েছে। আমরা কোস্টার নিয়ে পুরো দুটো দিন ঘুরে আমরা তৃতীয় দিনে যখন পুনাখায় পৌঁছলাম তখন দেখি সৌন্দর্যের অপার ঢালি নিয়ে অপেক্ষা করছে আরও একটি শহর। পুনাখা যাবার জন্য থিম্পু অফিস থেকেই একটা পারমিট নিতে হয়। টিম লিডাররা সেটা সকালেই করে রেখেছেন। সেজন্য সকালে উঠেই পুনাখার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পুনাখা প্রাকৃতিকভাবে অনেক সুন্দর শহর। যাবার পথেই পড়ল দোচালা পাস, এটি ভূমি থেকে ১০১৭১ ফুট উঁচু, চারপাশে মেঘ ঢেকে থাকে অধিকাংশ সময় আর শীতকালে বরফ পাওয়া যায় এখানে। দোচালা পাস শেষ করে রওনা হলাম পুনাখা জং দেখতে, পুনাখা জং হলো পুনাখার সরকারি প্রধান অফিস, এটি বহু আগে নির্মিত একটি দুর্গ, যা বর্তমানে অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জং দেখে, নদীতে রাফটিং করে, সাসপেনশন ব্রিজ দুলিয়ে আমরা আনন্দে উদ্বেলিত। যখন হোটেলে ফিরলাম তখন পা আর চলে না। পারোতে ছিলাম আমরা দুটো দিন। বিমানে এলে এখান থেকেই শুরু করতে হতো আমাদের যাত্রা। ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে আমরা যখন এই শহরে ঢুকি তখন একটি বিমানও ছিল না সেখানে। অবশ্য শেষদিন বিমানবন্দরে বিমান দেখতে পেয়েছি। পারোতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমতল ভূমি আছে কিছু, যাতে ধান চাষ হচ্ছে দেখলাম। শেষদিন আমরা ১০২৪০ ফুট উঁচু টাইগার নেস্টে উঠলাম। আসলে সবাই উঠতে পারেনি। আমরা কয়েকজন মধ্যবর্তী কোনো উচ্চতা থেকে নিচে নেমে এসে পাহাড় জয়ের অধরা স্বপ্নের জাল বুনেছি। অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানি দেওয়া ভুটানকে বলা হয় প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। ভ্রমণ পর্যটনের এক আদর্শ জনপদ এটি। কিন্তু বেড়ানোর এমন সম্ভাবনাময় দেশটি নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে পর্যটকের ঢল নামতে দেয়নি তাদের দেশে। শুধু ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বাসিন্দারাই ভুটানে পর্যটক হিসেবে আলাদা মর্যাদা পান। ইউরোপ, আমেরিকান পর্যটকদের ভুটান প্রবেশে বাড়তি গুনতে হয় দিনপ্রতি ২৫০ ডলার।

সর্বশেষ খবর