শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাজার বছরে রাজার শাসন!

কবির হোসেন সিদ্দিকী, বান্দরবান

হাজার বছরে রাজার শাসন!

এরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেরা নিজেদের রাজা বললেও আইন অনুযায়ী এদের প্রকৃত পদের নাম ‘সার্কেল চিফ’। ব্রিটিশ শাসনামলে চিটাগাং হিলট্র্যাকস রেগুলেশন ১৯০০ আইন বা চিটাগাং হিলট্র্যাকস ম্যানুয়েলের মতাবলম্বনে এই পদের সৃষ্টি হয়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এবং চাকমা বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেল বা অঞ্চলে বিভক্ত করে তারা...

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে এখনো রয়েছে রাজা প্রথা। শত বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তিন রাজার আদেশ নির্দেশ মেনে আসছে। তবে রাজাদের এখন তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদান, কর আদায়, সামাজিক কিছু বিচার-আচার করা ছাড়া তাদের তেমন কোনো কাজ এখন নেই। তবে তিন রাজার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাকমা, বোমাং ও মং তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। বোমাং সার্কেল বান্দরবান, চাকমা সার্কেল রাঙামাটি ও মং সার্কেল খাগড়াছড়িতে অবস্থিত। চাকমা এবং মং সার্কেলের নিয়ম অনুযায়ী রাজপরিবারের বড় ছেলে বংশপরম্পরায় রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলেও বান্দরবানের বোমাং সার্কেলে বংশের সবচেয়ে বড় জনই রাজা হয়ে থাকেন। বর্তমানে রাঙামাটিতে চাকমা রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, বান্দরবান বোমাং সার্কেলের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কে এস প্রু, খাগড়াছড়িতে মং রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাচিং প্রু চৌধুরী। জানা গেছে, ১৯৭৭ সালের ২৫ নভেম্বর রাঙামাটিতে দেবাশীষ রায়

আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা। ১৬ বোমাং রাজা কে এস প্রু মারা গেলে তার উত্তরসূরি উ চ প্রুকে ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালে বোমাং রাজা হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। সেই থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন।

খাগড়াছড়িতে মং সার্কেলের বর্তমান রাজা সাচিং প্রু । রাজা পাইহা প্রু চৌধুরী গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে সাচিং প্রুকে রাজা নিযুক্ত করা হয়। তিনি মং সার্কেলের ৯ম রাজা। এদিকে চাকমা সার্কেলে ১৭৮টি মৌজা, বোমাং সার্কেলে ৯৭টি এবং মং সার্কেলে ১০০টি মৌজা রয়েছে। হেডম্যানরা প্রতি মৌজার প্রধান হিসেবে কাজ করে থাকেন। প্রত্যেক পাড়ায় রাজার প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন একজন করে কারবারি। রাজা হেডম্যান এবং কারবারিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর হেডম্যান এবং কারবারিরা সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ কর আদায় করে থাকেন। এদিকে প্রতি বছর শীতের সময় তিন রাজা রাজপুণ্যাহের আয়োজন করে থাকেন। আর এ সময় প্রজারা তাদের জমির খাজনা প্রদান করেন। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় রাজকীয় অনুষ্ঠানমালার। তবে রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে রাজপুণ্যাহের প্রচলন তেমন একটা নেই। কিন্তু বান্দরবানে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে রাজপুণ্যাহ হয়ে থাকে। আর রাজপুণ্যাহে আদায় করা খাজনার শতকরা ৪২ রাজা, ৩৭ হেডম্যান এবং ২১ ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিলেন। পাকিস্তান আমল থেকেই বিভিন্ন সময় রাজাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের ক্ষমতা আরও কমতে থাকে।  এদিকে রাজারা এখনো সম্মানী পেয়ে থাকেন মাত্র ৫ হাজার টাকা। আর হেডম্যান ৫০০ এবং কারবারি ৩০০ টাকা। এ নিয়ে রাজা, হেডম্যান, কারবারিদের মাঝে রয়েছে ক্ষোভ। বোমাং রাজা বলেন, আমরা রাজা হলেও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না।

সম্প্রতি এক সম্মেলনে রাজাদের জন্য একজন বডিগার্ড এবং গাড়ি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিন রাজা। এদিকে রাজার তেমন কোনো ক্ষমতা না থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে  আসা পর্যটকদের এখনো আকর্ষণ করে রাজ প্রথা এবং রাজাদের পুরনো ইতিহাস। তাই দেশ-বিদেশ থেকে যারাই বেড়াতে আসেন সবাই একনজর হলেও দেখে যান রাজবাড়ী। সম্ভব হলে দেখা করে যান রাজার সঙ্গে। তবে এরা নিজেরা নিজেদের রাজা বললেও আইন অনুযায়ী এদের প্রকৃত পদের নাম ‘সার্কেল চিফ’। ব্রিটিশ শাসনামলে চিটাগাং হিলট্র্যাকস রেগুলেশন ১৯০০ আইন বা চিটাগাং হিলট্র্যাকস ম্যানুয়েল এর মতাবলম্বনে এই পদের সৃষ্টি হয়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এবং চাকমা বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেল বা অঞ্চলে বিভক্ত করে তারা। চাকমা সার্কেল চিফের অধীনে রাঙামাটি, বোমাং সার্কেল বান্দরবান আর মং সার্কেলের অধীনে খাগড়াছড়ি জেলাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই থেকে চালু হয় সার্কেল প্রথা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর