শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন

মানুষের পাশে ওরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মানুষের পাশে ওরা

সময় তখন ২০০০ সাল। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ছয় বছরের শিশু মমকে। দেশব্যাপী ওঠে আলোচনার ঝড়। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই নৃশংসতা বদলে দেয় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্কর জীবনের গতিপথ। এই বর্বরতা রুখতে সমবয়সী কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন শিশু নির্যাতনবিরোধী নাট্যদল। আস্তে আস্তে গড়ে তোলা হয় পাঠাগার, সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। গ্রামের পর গ্রামে কখনো পায়ে হেঁটে, চাঁদা তুলে, স্থানীয়দের সংগঠিত করে বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে গড়ে তোলেন ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।

 

দেশের ৩৬টি জেলার ৩৩ হাজার তরুণের প্রচেষ্টায় এই সংগঠন কোনো ধরনের বিদেশি অনুদান ছাড়াই বিপদাপন্ন মানুষের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ গল্প স্বপ্নবাজ তরুণ অমিয় প্রাপন চক্রবর্তী অর্কর। তরুণদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে অর্জন করে জাতীয় যুব পুরস্কার। এ ছাড়া ২০১৭ সালে কুইন ইয়াং লিডার (রানার্সআপ) নির্বাচিত হন তিনি।

 

সুহাশ চক্রবর্তী-শিবানী চক্রবর্তী দম্পতির প্রথম সন্তান অর্ক। ঠাকুরমা (দাদি) কমল চক্রবর্তী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং সহায়তা করার অপরাধে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের পৈতৃক বাড়িভিটা সব জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে সম্পত্তি হারিয়ে প্রিয় দেশকে সম্পদ করে এগিয়ে চলে বেগমগঞ্জের ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের পথচলা। মা ছিলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী। মায়ের মোটরসাইকেলের পেছনে ঘুরে গ্রামে গ্রামে মানুষদের সহায়তা করা দেখে আগ্রহী হতেন অর্ক। মা আর ঠাকুমার অনুপ্রেরণায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেড়ে ওঠা অর্ক ঝাঁপিয়ে পড়েন তরুণদের সংগঠিত করতে।

সংগঠনের সফলতার গল্প জানতে চাইলে বলেন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক তরুণের খোঁজ দেয় আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবক। আক্তার হোসেন নামের সেই ছেলেটি মাদকে আসক্ত হয়ে বেছে নেয় অন্ধকারের পথ। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে নিয়মিত দেখাশোনা করতে শুরু করে। বিভিন্ন রকমের মোটিভেশন দিয়ে আস্তে আস্তে তাকে মাদক থেকে দূরে সরানো হয়। কিন্তু অলস মস্তিষ্ক তো শয়তানের কারখানা। তাই এই তরুণকে যুব উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি এবং মৎস্য চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এখন তার খামারে প্রায় ৩০ জন তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে। একই অবস্থা ছিল বরগুনার বেতাগী উপজেলার সুখদেব হাওলাদারের। দেশীয় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করে সে নতুন চমক সৃষ্টি করেছে। তার কাছ থেকে এখন সবাই প্রশিক্ষণ নিতে আসে। ছোট ছোট এই সফলতাগুলো আমাদের কাজের প্রেরণা দেয়।

 

নারীদের নিয়ে এই সংগঠন কী কাজ করছে জানতে চাইলে বলেন, প্রতি ইউনিয়ন থেকে একজন কর্মসংস্থানহীন দরিদ্র নারীকে বাছাই করা হয়। এভাবে ২০টি জেলা শহর থেকে প্রায় ১ হাজার শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত হতদরিদ্র নারীকে বাছাই করে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা। এই নারীদের ৩ মাসের বিউটিফিকেশন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এখন একটা অনলাইন পেজ খুলে কোনো মূলধন ছাড়াই ব্যবসা করছে তারা। শুধু ফোন করলেই বাড়ি গিয়ে প্রয়োজনীয় পারলারের সেবা দিচ্ছে তারা। এজন্য তাদের কোনো ঘরভাড়ারও প্রয়োজন পড়ছে না। নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বেশ সচ্ছল তারা।

বন্যা, ঝড়, শীতে প্রতিবছর সামর্থ্যবানদের দুয়ারে হাত পেতে বিপদাপন্ন মানুষের জন্য সাহায্য তুলি আমরা। এরপর নিজেরা গিয়ে ক্ষুধা, অসুখে পীড়িত মানুষের হাতে তুলে দিই খাবার, ওষুধ পানীয়সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এখন সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষদের প্রশিক্ষিত করার কাজ করছি আমরা। মাঝে মাঝে অর্থাভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আমাদের। স্বপ্ন অনেক কিন্তু সরকারি-বেসরকারি অনুদানের অভাবে আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। তারপরও হতাশ না হয়ে সদস্যদের চাঁদা আর মানুষের যৎসামান্য সাহায্যে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি আমরা।

 

শৈশব এবং বেড়া ওঠা কোথায় জানতে চাইলে বলেন, বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেছি। এরপর চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। সংগঠনের কী হবে এ কথা ভেবে নোয়াখালীর বাইরে যাওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না আমার। তাই নোয়াখালী সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। আস্তে আস্তে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাড়তে থাকে আমার এই সংগঠন। এক সময় ১৪টি জেলায় কাজ করতে থাকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী তরুণরা। স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পরীক্ষা শেষে চিন্তা করি ঢাকায় সংগঠনের কাজ শুরু করার। এরপর ব্র্যাক থেকে এমবিএ সম্পন্ন করি। ২০১৪ সালে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। এই সংগঠন নিয়ে স্বপ্নের জায়গা জানতে চাইলে বলেন, ১৮ বছরের এই পথচলায় কোনো বিদেশি দাতা গোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই ১৮ হাজার ৯৪২ জন তরুণ-তরুণীকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছি আমরা। ধ্রুবতারাই প্রথম জাতীয় যুবনীতির সংশোধনের খসড়া সরকারের কাছে পেশ করে। যা সম্প্রতি সংসদে পাস হয়েছে। দুস্থ মানুষের জন্য নোয়াখালী সুবর্ণচরে হাসপাতাল নির্মাণ করা এবং ইয়ুথ ব্যাংক গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে। স্বপ্ন তো অনেক। কিন্তু বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো মনে হলেও মানুষ হিসেবে বিবেকের কাছে তো দায়ী নই। দুঃখী মানুষের চোখের জল মুছে দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর