শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই

তানিয়া তুষ্টি

বৃক্ষমাতা ওয়াঙ্গারি মাথাই
পরিবেশ দূষণ রোধ, গ্রামীণ নারীদের জীবন-জীবিকার জন্য গাছ লাগানো, বিশুদ্ধ পানি, রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করতে খ্যাতিমান পরিবেশবিদ ও নারী আন্দোলনের কর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাই প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’।

 

কেনিয়ার খ্যাতিমান পরিবেশবিদ ও নারী আন্দোলনের কর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাই। ১৯৭৬ সালে তিনি কেনিয়ার জাতীয় নারী পরিষদে (ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন) ছিলেন। লেখাপড়া বিদেশে হলেও কেনিয়ার গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির খুব কাছ থেকে তার জানাশোনা। মাটির গন্ধ তাকে খুব টানত। ওয়াঙ্গারি ১৯৬৪ সালে আমেরিকার মাউন্ট সেন্ট স্কলাসটিকা কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানে বিএস, ১৯৬৬ সালে পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস এবং ১৯৭১ সালে নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যানাটমি বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে অধ্যাপনার সময় কেনিয়ার নির্যাতিত নারীদের জন্য কাজ করছিলেন। এই সময় তিনি দেখলেন কৃষকদের ফসল উৎপাদন থেকে বিরত রেখে স্বার্থান্বেষী মহল রপ্তানির জন্য অর্থকরী ফসল চা ও কফি উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এতে উজাড় হচ্ছে বন। কৃষক খাদ্য উৎপাদন করতে পারছে না। নারী ও শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, গবাদিপশুর খাদ্য নেই, রান্নার জন্য জ্বালানি নেই, খাওয়ার জন্য পানি নেই। নিজ দেশের এই ভয়াবহ সংকটের সমাধান কোথায়? এমন ভাবনা থেকেই একটি সহজ সমাধান বের করলেন ওয়াঙ্গারি, গাছ লাগানো। তার মতে, গাছ খাদ্য দেবে, গাছ রান্নার জ্বালানি দেবে; গাছের মাধ্যমেই মিলবে প্রকান্ড এই সমস্যার সঠিক সমাধান।

এক পর্যায়ে গ্রামীণ নারীদের জীবন-জীবিকার জন্য গাছ লাগানো, পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করা, রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তার এই আন্দোলনের শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। তবে কঠিন হলেও সম্ভব করে ছেড়েছিলেন ওয়াঙ্গারি মাথাই। তার উদ্যোগে কেনিয়াতে সে সময় সাড়ে চার কোটি গাছ লাগানো হয়, প্রায় নয় লাখ নারী চারার নার্সারি করে, গাছ লাগিয়ে রুখতে পেরেছিলেন মরুময়তা, ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন কর্মসংস্থানের। গ্রামীণ নারীর পাশাপাশি গির্জা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার গাছ লাগানোর কাজ ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন আর গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই আন্দোলনে যোগদান করে তানজানিয়া, উগান্ডা, মালাবি, লেসোথো, ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়েসহ আরও কয়েকটি দেশ গাছ লাগিয়ে মরুময়তা রোধ করার উদ্যোগ নেয়।

১৯৪০ সালের ১ এপ্রিল কেনিয়ার নায়েরি জেলায় কিকুয়ু নামের বিখ্যাত এথনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াঙ্গারি মাথাই। অধ্যাপিকা মাথাই তার পরিবেশ ও সমাজবাদী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে ফোর্বস এবং টাইম ম্যাগাজিনের তৈরি বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ছিলেন মাথাই। ২০০৬ সালে মাথাইকে ফ্রান্স সরকার সে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক ‘লেজিও দ্য অনার’-এ ভূষিত করে। এ বছরই তিনি ভারতের ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

একটি গাছ লাগালেই মিলবে কয়েক সেন্ট। অভিনব এ পরিকল্পনা নিয়েই ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’ এর যাত্রা শুরু করেন অধ্যাপক ওয়াঙ্গারি মাথাই। নাইরোবির একমাত্র পার্কে বহুতল ভবন তৈরির সরকারি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন এ সংগঠক। আর সেই থেকেই মাথাইয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাত তৈরি হয় কেনিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল অ্যারাপ মোইয়ের। জেল-জলকামান-পুলিশের লাঠি দিয়ে সরকারের তীব্র দমননীতির সামনেও এগিয়ে যান মাথাই ও তার ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’।

নাগরিক ও নারী অধিকারের জন্যও আজীবন লড়াই চালিয়ে যাওয়া সংগ্রামী এ নারী সত্তরের দশকে কেনিয়া রেড ক্রসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কেনিয়ার পরিবেশবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাথাইয়ের পরিবেশ আন্দোলন ক্রমে কেনিয়ায় গণতন্ত্র ও শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং শোষণ-দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন সংগ্রামী এই নারী। তিনি দেহত্যাগ করলেও পৃথিবীব্যাপী কর্মে বেঁচে আছেন আজও। কাজের পাশাপাশি তার বিশেষ কিছু উক্তি আজও সবার অনুপ্রেরণা জোগায়। যেমন-

* মানবাধিকার এমন কোনো বস্তু নয় যে ওটা মানুষের ভোগের জন্য টেবিলের ওপর পড়ে থাকবে। অনেক যুদ্ধের পর ওটা অর্জন করে নিজেকে সুরক্ষিত করতে হয়।

* সারা জীবনে আমি কোথাও থামতে শিখিনি। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সেটা আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছি। দরজা খোলা পেলেই আমি এগিয়ে গেছি। থামিনি কখনো। হাঁটুতে জোর থাকা পর্যন্ত- আমি হেঁটেই যাব।

*  যে প্রজন্ম পরিবেশ ধ্বংস করছে, তারা তো এটার জন্য ভুগছে না- ভুগছে পরবর্তীরা। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।

সর্বশেষ খবর