শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেই যুদ্ধশিশু আনোয়ারার যত কথা

শেখ মেহেদী হাসান

সেই যুদ্ধশিশু আনোয়ারার যত কথা

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও অবাধ যৌনচার। ধর্ষিত নারীর গর্ভে বহু শিশুর জম্ম  হয়। অক্টোবর ’৭১ থেকে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জম্ম  নেওয়া অনাকাক্সিক্ষত শিশু ও  বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তালিকা করা হয়নি। তাদের মায়েরা জম্ম  কালেই নিরুপায় হয়ে সন্তান ত্যাগ করে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বহু শিশুর নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়। যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকেরই আশ্রয় হয় মাতৃসদনে। কোনো কোনো মা সন্তান ফেলতে না পেরে ভিন-জেলায় কিংবা অবৈধ পথ পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর এসব শিশুকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘বেআইনি শিশু’ বা ‘যুদ্ধশিশু’। সম্ভবত আনোয়ারা তাদের একজন। ১৯৭৮ সালে তাকে দত্তক নিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের এক শিক্ষক পরিবার। তার পালক বাবা এভার্ট ডেকার আর মা ম্যারিয়েন রেজনেভেল্ড। নতুন মা-বাবার আশ্রয়ে জীবন বদলে যায় তার। মাতৃসদনের জীবন থেকে একান্ত বাড়ির পরিবেশে বাবা-মায়ের আদরে বড় হন তিনি। আনোয়ারা বলেন, ‘জম্মে র পর আমার আশ্রয় হয় টঙ্গীর একটি শিশুসদনে। যতদূর মনে পড়ে সেখানে ৮-১০ জন শিশু মিলে আমরা খেলতাম। মাঝে মাঝে সম্ভবত আমাদের দিয়ে কাজ করানো হতো। আরেকটু স্পষ্ট করলে মনে পড়ে, আমি বাম হাত দিয়ে কী যেন গুঁড়া করতাম। আর ডান হাত দিয়ে কিছু একটা টেনে দিতে হতো আমাকে। আর বিশেষ কিছু মনে পড়ে না। আশ্রয় কেন্দ্রের খাদ্যাভাব এবং একটি শিশুর কথা খুব মনে পড়ত। কারণ ওই শিশুটি ছিল আমার ছোট বোন শম্পা।’

নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পর নতুন পরিবেশে আনোয়ারা পেয়েছিল সুন্দর জীবন। তার বোনকেও নেদারল্যান্ডসের অন্য একটি পরিবার দত্তক হিসেবে নিয়ে আসে। তারপর থেকেই দুই বোন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার আগে আনোয়ারা জানত না প্রতিদিন সময়মতো খাবার পাওয়া যাবে কিনা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তার জীবন বদলে যেতে থাকে। বেসিক স্কুল পড়াশোনা শেষ করে নার্সিং বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেন আনোয়ারা। বর্তমানে তিনি নেদারল্যান্ডস্রে একটি হাসপাতালে সেবিকার কাজ করছেন। আনোয়ারা ডাচ নাগরিক। তার বয়স পয়তাল্লিশ। তার বিয়ে হয়েছে টমাস নিউয়ের সঙ্গে। টমাস একজন ব্যাংকার। তাদের দুই সন্তান। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তার।

কিন্তু তার মনে ছিল গভীর শূন্যতা। কারণ তার দুই মেয়ে আসিয়া আর মুনা। একজনের বয়স ১০, আরেক জনের ১১। তারা জিজ্ঞেস করত তাদের নানা-নানী কে? আনোয়ারা এর উত্তর দিতে পারতেন না। তার মন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। আনোয়ারা নিজেও জানত না তার মা-বাবা কে! কোথায় হারিয়েছেন তাদের!

আনোয়ারা নিজের শিকড়ের সন্ধানে ১৯৯২ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু পরিচিত তেমন কেউ না থাকায় ঢাকায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হয়নি। টঙ্গী গিয়েও তিনি ছোটবেলার সেই স্থানটি খুঁজে বের করতে পারেননি। এরপর ২০০৫ সালে আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন আনোয়ারা। সে সময়ই কিছু ডাচ্ বন্ধুর সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। আনোয়ারার ডাচ্ বন্ধুদের বাংলাদেশি বন্ধুরা এ বিষয়ে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘সে সময় বাংলাদেশি যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমি চেষ্টা করেছি আমার মা ও স্বজনদের খুঁজে পেতে। বাংলাদেশে আমার পরিচিত নেদারল্যান্ডসের কেউ গেলেই আমি একই কথা বলি। আমার স্বজনদের খুঁজে পাওয়া যায় কিনা যাতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবার নিরাশ হয়েছি। আমিও তেরেসা ও মার্থা নামে দুটো মেয়েকে দত্তক নিয়েছি। হয়তো ওদেরও একদিন আমার মতো অবস্থা হবে।’ নিজের স্বজনদের খুঁজে পেতে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে আনোয়ারা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশে আসেন। তখন তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। তাকে নিয়ে (৩ মার্চ ২০১৮) একটি ফিচার প্রকাশ করা হয়। ফিচারটি সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ওই সময় মাতৃসদনের রেকর্ড অনুযায়ী টঙ্গীর দত্তপাড়া, কুমিল্লার আড়াইহাজার, লালুরকান্দি চষে বেড়িয়েছেন, পোস্টার-লিফলেটে ছেয়ে দিয়েছিলেন পুরো এলাকা কিন্তু কোনো ফল হয়নি। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে। অনেকেই যোগাযোগ করে কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে আনোয়ারা ফিরে যান তার কর্মস্থলে। সেখানে আচমকা খুঁজে পান তার হারিয়ে যাওয়া বোন শম্পাকে। আর এদিকে ময়মনসিংহের মেয়ে ঐশী পত্রিকায় ছবি দেখে প্রথমবারের মতো আনোয়ারাকে চিনে ফেলেন। তিনি জানান, আনোয়ারার ভাই ছুতু, বোন সুলেমুন্নেসা বেঁচে আছেন। ঐশী, গফরগাঁও সাবরেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক শ্যামল দত্তের কন্যা। এই শ্যামল দত্তের বাড়িতে আনোয়ারার মা গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।

ঐশীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার ভাই-বোনের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আনোয়ারা সত্যিকার অর্থে ছুতু ও সুলেমুন্নেসার বোন। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও। ১৬ জুলাই ২০১৮তে আনোয়ারা তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে স্বামী সন্তানসহ বাংলাদেশে আসেন এবং ১৭ জুলাই ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও যান। গ্রামে নিজ বাড়ির উঠোনে ভাইবোনদের সঙ্গে প্রথম দেখার পর এক আবেগপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সবার চোখ ভিজে যায় আনন্দাশ্র“তে। এই দৃশ্য দেখার জন্য এলাকার শত শত লোক তাদের বাড়িতে ভিড় জমায়।

যুদ্ধশিশু আনোয়ারার বাবা ছিলেন দিনমজুর এবং মা গৃহপরিচারিকা। আনোয়ারার বাবা-মা’র মৃত্যুর পর তাদের একমাত্র ভাই এবং এক বোন গফরগাঁওয়ের খাড়–য়ামুকুন্দ গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করতেন।

আনোয়ারা তার স্বজনদের খুঁজে পেয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ধন্যবাদ  জানিয়েছেন। তিনি তার ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে  চান।

সর্বশেষ খবর