শিরোনাম
শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ পুরস্কার -২০১৮

প্রফেসর রাব্বানীর হাত ধরে টেলিমেডিসিনে বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশ

প্রফেসর রাব্বানীর হাত ধরে টেলিমেডিসিনে বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশ

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

গত ১২ অক্টোবর শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরের সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে আয়োজিত তৃতীয় কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ অ্যাওয়ার্ডস-২০১৮ এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের জন্য ছিল একটি অনন্য সন্ধ্যা। টেলিমেডিসিন বিভাগে ‘রানার্সআপ’ এবং ‘উইনার’ দুটি পুরস্কারই বাংলাদেশের হাতে আসে। প্রফেসর রাব্বানীর হাত ধরেই টেলিমেডিসিনে বিশ্বের শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। লিখেছেন- সাইফ ইমন

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিমেডিসিন কার্যক্রমের কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ লাভ করেছে। গত ১২ অক্টোবর শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরের সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে আয়োজিত ৩য় কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ অ্যাওয়ার্ডস-২০১৮ এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের জন্য ছিল একটি অনন্য সন্ধ্যা। টেলিমেডিসিন বিভাগে ‘রানার্সআপ’ এবং ‘উইনার’ দুটি পুরস্কারই বাংলাদেশের হাতে আসে। রানার্সআপ হয় টেলিনর-গ্রামীণফোনের ‘টনিক’ প্রকল্প এবং উইনার বা বিজয়ী হিসেবে  ঘোষিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিমেডিসিন কার্যক্রম’ প্রকল্প, সংক্ষেপে যার নামকরণ ছিল, ‘টেলিমেডিসিন-বাংলাদেশ।

কমনওয়েলথ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ভাজিরা ডিসানায়েক-এর কাছ থেকে টেলিনর হেল্ড বাংলাদেশের চিফ অফিসার ম্যাথিউ গিলফোর্ড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিমেডিসিন কার্যক্রম’ এর পরিচালক অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী যথাক্রমে পুরস্কার গ্রহণ করেন।

এই প্রফেসরের হাত ধরেই বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন প্রসার লাভ করেছে। তিনি প্রফেসর ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন। যার সব উদ্ভাবনের একটাই লক্ষ্য, তা হলো কম খরচে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি তৈরি ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আবার তিনি তার উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট করাতে নারাজ। তার কথা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির সুবিধা ভোগের অধিকার সবার রয়েছে। তা প্যাটেন্ট করে ব্যবহার সীমিত করা মোটেই উচিত নয়। তাই এত বছরের গবেষণায় শুধু একটি প্যাটেন্টই করিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। ১৯৯২ সালে করা প্যাটেন্টটি হলো ‘অটোমেটিক ভোল্টেজ প্রটেকশন’। তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেরাই যদি চিকিৎসা ও ব্যবহার্য প্রযুক্তি তৈরি করতে পারি, তাহলে একই সঙ্গে সাশ্রয়ী ও সংস্কৃতিবান্ধব ও সর্বজনীন হবে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে কম খরচে। ড. সাইয়েদ ও অধ্যাপক ইসলামের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি বাংলাদেশে মেডিকেল ফিজিক্স ও বায়োমেডিকেল প্রকৌশলে গবেষণার সফল সূত্রপাত করেন ১৯৭৮ সালে। এর কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্য থেকে ইলেকট্রনিক্সে পিএইচডি শেষে দেশে ফেরত আসেন প্রফেসর ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী। উন্নত বিশ্বের আকর্ষণীয় সব চাকরির অফার ফিরিয়ে দেন শুধু দেশের মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকে। সেই থেকে এখন অবধি একঝাঁক তরুণ নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা এই বিজ্ঞানী। বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী একজন প্রতিভাবান ফটোগ্রাফারও বটে। আমাদের দেশে বর্তমানে ফটোগ্রাফি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ’৮০-এর দশকের শুরুতেই ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী সাফল্য অর্জন করেন ফটোগ্রাফিতে। তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত জাতীয় ফটো কনটেস্টে রঙিন ছবির ক্যাটাগরিতে প্রথম এবং সাদা-কালো ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এরও আগে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটি আয়োজিত এক কনটেস্টে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে গবেষণার কাজে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফটোগ্রাফিতে সময় দিতে পারেননি ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী। আমাদের দেশে টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা পায় প্রফেসর রাব্বানীর হাত ধরেই। বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে কোনো ডাক্তার নেই। তাই শহরে বাস করা ডাক্তারদের চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়ার জন্য টেলিমেডিসিনই একমাত্র সমাধান হতে পারে। ইলেকট্রনিক এবং কম্পিউটারভিত্তিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি স্থানীয়ভাবে তৈরির কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা নিয়ে অধ্যাপক রাব্বানীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলটি ২০১১ সালে এ লক্ষ্যে টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। তাদের উন্নয়ন করা প্রযুক্তির বিশেষত্ব হলো সফটওয়্যারের পাশাপাশি স্টেথোস্কোপ এবং ইসিজি যন্ত্র নিজস্বভাবে ডিজাইন ও তৈরি করা যার মাধ্যমে রোগীর এসব তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে দূরের ডাক্তারের কাছে চলে যেতে পারে। তিনি পিসি বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে রোগীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমেই প্রেসক্রিপশন তৈরি করে দেন যা ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত হয়ে যায় ও অপারেটর তা প্রিন্ট করে রোগীকে দিয়ে দেন। রোগী, অপারেটর ও ডাক্তারের জন্য সহজ করার জন্য সফটওয়্যারটি করা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে।

প্রযুক্তি উন্নয়নের পাশাপাশি স্বনির্ভরতাকে সামনে রেখে একটি উদ্যোক্তানির্ভর মডেলের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি নিজেরাই সেবা প্রকল্পটি চালু করে। ২০১৩ সাল থেকে দুই বছর সফল মাঠ পরীক্ষণ শেষে সরকারি অনুমতি নিয়ে নভেম্বর ২০১৫ থেকে সারা বাংলাদেশে এ সেবাটি চালু করার উদ্যোগ নেয় দলটি। বর্তমানে ৩০টিরও বেশি গ্রামীণ সেবা কেন্দ্র চালু রয়েছে। ১৩ জন ডাক্তার যার যার পছন্দমতো জায়গায় থেকেই কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পরামর্শ সেবা দিতে পারছেন। এ পর্যন্ত ১৫,০০০ এরও বেশি চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইদানীং কয়েকটি এনজিও যেমন জীয়ন, বিসিএনইপিএস, সিআরপি এবং ব্র্যাক টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রকল্পে যোগ দিয়েছেন।

এ প্রকল্পের বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ফার্ম ফ্রেশ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এটুআই (বর্তমানে আইসিটি ডিভিশনে অন্তর্ভুক্ত), বেক্সিমকো ফার্মা, আইএসআইএফ (অস্ট্রেলিয়া), ইএমকে সেন্টার (ঢাকা) এবং কয়েকজন ব্যক্তি দাতা। বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অর্থায়ন এবং সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফান্ড থেকেও এ গবেষণায় আংশিক সাহায্য এসেছে। এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া ও এর বাধাগুলোকে দূর করার জন্য এটুআই এর চলমান সহযোগিতা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সারা বিশ্বের, বিশেষ করে বঞ্চিত মানবগোষ্ঠীর কল্যাণে এ দলটি তাদের কোনো উদ্ভাবনের পেটেন্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশেও এ সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দলটি পরিকল্পনা করছে। এ পর্যন্ত এই প্রকল্পটি পেয়েছে ব্র্যাক-মন্থন-২০১৬ উইনার’ পুরস্কার, মন্থন-দক্ষিণ এশিয়া -২০১৬ এ ‘ফাইনালিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি এবং জেনেভাতে ডব্লিউএসআইএস-২০১৭-তে চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার (এটুআই এর মাধ্যমে)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন করা প্রযুক্তি এত বড়ভাবে দেশের সাধারণ মানুষের সরাসরি উপকারে লেগেছে।

সর্বশেষ খবর