শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মেগা প্রকল্পে পাল্টে যাচ্ছে দক্ষিণের দ্বীপকন্যা

ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী

ফারুক তাহের, মহেশখালী থেকে ফিরে

মেগা প্রকল্পে পাল্টে যাচ্ছে দক্ষিণের দ্বীপকন্যা

সমুদ্রপৃষ্ঠের এক নৈসর্গিক জনপদের নাম মহেশখালী। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই সুবিধাবঞ্চিত দ্বীপকন্যা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকলেও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার কারণে পাল্টে যেতে বসেছে এর অতীত চিত্র। উন্নয়নের কিছু মেগা প্রকল্প সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। অবহেলিত মহেশখালীতে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পরিকল্পিত নগর। ইতিমধ্যে এই দ্বীপ উপজেলাকে সরকারিভাবে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ ঘোষণা করা হয়েছে। মহেশখালীতে নির্মিত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন শেষে ওই টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে এখানে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রসার ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরেজমিন জানা যায়, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কোল-পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী মৌজার ১৪১৪.০৫ একর ভূমি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করা হয়। এ পর্যন্ত ৮০ শতাংশ জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। যদিও ক্ষতিপূরণের টাকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারপরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেন্টা-ওশান প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে। ইতিমধ্যে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ৭০ ফুট গভীরের চ্যানেল, বাঁধ, ল্যান্ডিং, জেটি, গুদাম ও অফিস বিল্ডিং নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। বসানো হয়েছে নতুন পুলিশ ফাঁড়িও। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সরকারের মহাপরিকল্পনা হিসেবে মাতারবাড়ীকে ‘বিদ্যুৎ হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য বন্দরটি পরবর্তীতে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তর করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে স্থায়ী চ্যানেল ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও দেশের সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে মহেশখালীকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলাও সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাটায় ১৪১৪.০৫ একর জমিতে এ প্রকল্পটির নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সমুদ্র বন্দর চালু এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। কারণ সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ু, তরঙ্গ বা ঢেউ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন, লবণাক্ততার মাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির জোগান পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। প্রতি বছর সেখান থেকে ৬৬ লাখ টন মৎস্য আহরণ করা সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে সেখান থেকে খুব কমই আহরণ হচ্ছে। মহেশখালীর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। মৎস্য সম্পদ ছাড়াও সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বহু খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তলদেশ থেকে যেসব সম্পদ পেতে পারে তা হলো বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যেমন- গ্যাস, তেল, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল-পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম জানান, ইতিমধ্যে মাতারবাড়ী প্রকল্পের জন্য ৪০০ জন দক্ষ শ্রমিক বিদেশ থেকে এসেছে এবং ১১০০ দেশি-বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে। তিনি বলেন, পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তবে জাপানি কনসোর্টিয়ামের অন্যতম কোম্পানি তোশিবা করপোরেশন আরও সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য ২০১৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৩৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের কার্যপত্রে বলা হয়- জাইকা এ প্রকল্পে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে। দরপত্র প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই গুলশান হামলায় ১৭ জন বিদেশি নিহত হওয়ার পরদিন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করে সরকার। এরপর জাইকার সবচেয়ে বড় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয় সংশয়। কিন্তু— সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে গত বছরের ২৭ জুলাই কনসোর্টিয়াম সুমিতুমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে কোল পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ (সিপিজিসিবিএল)।

এদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনেক দিন থেকেই দেখা দিয়েছে। বর্তমান সরকার মহেশখালীর সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রকল্প অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে রাখলেও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমদানি করা কয়লা নির্ভর হওয়ায় কয়লা আনার জন্য ৫৯ ফুট গভীরের বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এ বন্দরে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নোঙর করতে পারবে। জাপানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যে সমুদ্র বন্দর নির্মিত হচ্ছে, সেটিই পরবর্তীতে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে গভীর সমুদ্র বন্দর। মাতারবাড়ী প্রকল্প পরিদর্শনকালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় নির্মিত বন্দরটি পরবর্তীতে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে মহেশখালীর ৬টি মৌজা যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে সেসব জমিতে লবণ ও চিংড়ি চাষ হয়। মহেশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নগর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে সরকার।

এদিকে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, মাতারবাড়ীতে যে এনার্জি হাব হচ্ছে তার বাইরেও মহেশখালীকে একটি ট্যুরিজম শহর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সোনাদিয়া দ্বীপে একটি ইকো ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলা হবে। এ জন্য প্রায় দশ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি নিয়ে দ্বিতীয় জাহাজ মহেশখালীতে পৌঁছার পর থেকেই ভাসমান টার্মিনালে এই এলএনজি স্থানান্তরের কাজ শুরু করেছে আরপিজিসিএল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খায়ের আহমদ মজুমদার জানান, ‘আমাদের লাইনে এখন ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছে জিটিসিএল। এতে শিল্প-কারখানায় ও বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে। এ গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে এখন থেকে আবাসিকের সমস্যাও দূর হবে।’

সর্বশেষ খবর