‘টেন-পিন বোলিং’ খেলা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ খুব একটা জানে না। তবে বিশ্বজুড়ে এই খেলার কদর অনেক। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে এই খেলা বেশ জনপ্রিয়। ওয়ার্ল্ড বোলিং নামে বিশ্বব্যাপী এই খেলার একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। তিনটি জোনে বিভক্ত এই সংস্থার কার্যক্রম বেশ জোরা লো এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়ারই তিনটি দেশ টেন-পিন বোলিং খেলে। এর মধ্যে ভারত ছাড়াও আছে নেপাল ও পাকিস্তান। বাংলাদেশে এই নিয়ে কোনো ফেডারেশন তো দূরে থাক, ক্লাবও নেই। তবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে টেন-পিন বোলিংয়ে বাংলাদেশকে পথ দেখাচ্ছেন মোশাররফ হোসেন আহমেদ।
স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারে টেন-পিন বোলিং অনেক বাচ্চারাই এখন খেলে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এই খেলার সঙ্গে পরিচয় আছে খুব কম মানুষেরই। অনেকটা পুতুলের মতো দেখতে ১০টি পিন থাকে একটি কাঠের লেনের শেষ মাথায়। এই লেন কখনো কখনো সিনথেটিকও হতে পারে। মোটামুটি ফুটবলের আকৃতির একটি বল দিয়ে রোল করিয়ে এই পিনগুলো ফেলে দিতে পারলেই পয়েন্ট। কাঠের অথবা সিনথেটিক লেনটা সাধারণত ৬০ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট সাড়ে ৫ ইঞ্চি চওড়া হয়ে থাকে। এই লেনের মধ্য দিয়ে বিশেষ কায়দায় বলটাকে রোল করাতে হয়। শুনতে যতটা সহজ বলে মনে হয়, বাস্তবে ততটা নয়। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং কঠোর অনুশীলন। তবেই টেন-পিন বোলিংয়ে সফলতা আসতে পারে। এই খেলার নিয়মটাও বেশ মজার। সবগুলো পিন একবারে ফেলে দিতে পারলে তাকে বলে ‘স্ট্রাইক’। দুবার বোলিং করে সবগুলো পিন ফেলতে পারলে তাকে বলে ‘স্পেয়ার’। এর মধ্যে স্ট্রাইক মারতে পারলে বোনাস পয়েন্ট পাওয়া যায়। স্কোরিংয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে অঞ্চলভেদে। তবে মজার এই খেলাটা নিয়ে আগ্রহ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। পনেরো বছর আগে টেন-পিন বোলিং দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন আহমেদ। সেই থেকেই খেলাটার প্রেমে পড়ে যান তিনি। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাস তাদের কর্মচারীদের জন্য এই খেলার আয়োজন করে থাকে। কিছু স্কুল-কলেজেও এই খেলার সুযোগ আছে। তবে কোনো ক্লাব নেই। ফেডারেশন তো দূরে থাক। মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাকে খুব কষ্ট করে এই খেলাটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এখনো আমাদের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় আমাকে অনেক টুর্নামেন্টেই অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না।’ এতদিনকার এই সমস্যাটা অবশ্য মিটে গেছে। মোশাররফ বর্তমানে মালয়েশিয়ার পেনাঙ টেন-পিন বোলিং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পদ লাভ করেছেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। বার বার মেইল করতে হয়েছে তাদের। অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে হয়েছে। তারপরই সদস্য পদ লাভ করেছেন মোশাররফ। অবশ্য তার আগে এশিয়া প্যাসিফিক মাস্টার্স গেমসে অংশগ্রহণ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন তিনি। মোশাররফ বলেন, ‘আমাদের দেশে কোনো সুযোগ না থাকার পরও আমার পারফরম্যান্সে ওরা বেশ খুশি হয়েছে। এই কারণেই সদস্য পদ দিয়েছে ওরা।’ তিনি মালয়েশিয়ার ক্লাবটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মোশাররফ হোসেন নিজে অনেক দূর যেতে পারবেন কি না এই ব্যাপারে এখনো তিনি অন্ধকারে। তিনি বলেন, ‘আমার এখন বেশ বয়স হয়ে গেছে। তবে এই খেলাটা বয়স্করাও খেলতে পারে। আর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে আমি খুবই ভা লো করতে পারব বলে আশা করি।’ এখনো বিশ্ব সেরাদের সঙ্গে মোশাররফের ব্যবধান খুব একটা নয়। এই ব্যবধানের কারণ হিসেবে মোশাররফ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়াকেই দায়ী করছেন। তবে এই খেলাটা তিনি আনন্দ নিয়ে খেলে থাকেন বলে জানিয়েছেন। মোশাররফ বলেন, ‘আমাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যবসা করি তো। নানা রকমের দুশ্চিন্তা থাকে। কিন্তু এই খেলাটা শুরু করার পর থেকে আমার নিজেকে অনেক চাপমুক্ত মনে হয়।’ আগামী ডিসেম্বরে ৪৬তম পেনাঙ পেস্তা ইন্টারন্যাশনাল বোলিং চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিতে চান তিনি। মোশাররফ এখনো পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি টেন-পিন বোলিং থেকে। তবে তিনি আশা করেন, তারই পথ ধরে এই খেলায় বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বিশ্ব জয় করবে। টেন-পিন বোলিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ অ্যানথ্রোপলজিস্ট স্যার ফ্লিন্ডারস পেট্রি একদল আর্কিওলজিস্ট নিয়ে মিসরীয় সভ্যতায় খেলা বোলিং বল, বোলিং পিন এবং অন্যান্য উপকরণ খুঁজে পান। প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ বছর আগের এই খেলা আবিষ্কৃত হলে সারা দুনিয়াতেই হইচই পড়ে যায়। অবশ্য আধুনিক যুগে এ খেলাটা ফ্লিন্ডার্সের এই আবিষ্কারের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে ১৯৪০ সালের পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। তবে আন্তর্জাতিক খেলা হিসেবে এই
খেলা মর্যাদা পায় ১৯৮৮ সালে অলিম্পিক খেলা হিসেবে স্বীকৃত পাওয়ার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এরপর আর অলিম্পিকের তালিকা থেকে এই খেলাটা বাদ পড়ে যায়। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে টেন-পিন বোলিংকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে এশিয়ার ৩৮টি দেশে এই খেলা খুবই জনপ্রিয়। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ছাড়াও টেন-পিন বোলিংয়ের অসংখ্য টুর্নামেন্ট আছে। বর্তমানে এশিয়ান গেমস এবং প্যান আমেরিকান গেমসে টেন-পিন বোলিং খেলাটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। খেলার জগতে বাংলাদেশের আছে সদর্প বিচরণ। ক্রিকেটের সেরা দলগুলোর মধ্যে এখন বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়। ফুটবলেও ধীরে ধীরে উঠে আসছে বাংলাদেশ। ছেলেরা পিছিয়ে থাকলেও মেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। শুটিংয়ে বাংলাদেশ সোনা জিতেছে কমনওয়েলথ গেমসে। টেন-পিন বোলিংয়েও আনুষ্ঠানিক যাত্রা হলে ভালো করতে পারে বাংলাদেশ। মোশাররফ হোসেনদের মতো অনেকেই হয়তো ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই খেলাটা শেখার চেষ্টা করছেন। তাদের কেবল প্রয়োজন সংগঠিত হয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ। মোশাররফ হোসেন দাবি করেছেন, ‘সুযোগ পেলে আমরাও দেখিয়ে দিতে পারতাম, বাংলাদেশে টেন-পিন বোলিংয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে।’ মোশাররফ হোসেনদের ইচ্ছা কতদিনে পূরণ হবে, বলা কঠিন!