শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. পিটার ইগেন

কারও একার পক্ষে কোনো দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

কারও একার পক্ষে কোনো দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়

৮ নভেম্বর, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টা। জার্মানির ফক্সবোর্গে বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ভক্সওয়াগনের অটোস্ট্যাডে গ্লোবাল সোশ্যাল বিজনেস সামিটের  উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব শেষ হলো। মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যমণি শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর এক পাশে দাঁড়ানো জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ড. মারিয়া ফ্লেক্সবার্থ, যিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন। আরেক পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে কথা বলছিলেন এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি। তিনি ভাষণ দেননি। ফলে তাঁর পরিচয়টাও জানা হয়নি।

‘হ্যালো’ বলে সামনে দাঁড়াতেই প্রফেসর ইউনূস ওই দীর্ঘদেহীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অঞ্জন, তিনি হচ্ছেন ড. পিটার ইগেন, যিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর মূল উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান। বর্তমানে সংস্থাটির উপদেষ্টা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল! জার্মানির বার্লিনভিত্তিক অরাজনৈতিক, অলাভজনক একটি বেসরকারি সংস্থা। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি প্রতিরোধে যে সংস্থাটি কাজ করছে। বাংলাদেশেও যার একটি চ্যাপ্টার আছে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) নামে। সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এটা আমার জন্য একটা বিরাট সারপ্রাইজ ছিল।

আমি তাঁকে জানালাম যে, বাংলাদেশে টিআই-এর চ্যাপ্টার টিআইবি’র স্বেচ্ছাসেবী সদস্য (ইয়েস মেম্বার) হিসেবে কাজ করেছি আমি। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে তখনকার টিআইবির সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর সভাপতি ছিলেন সাংবাদিক এম এ হাকাম হীরা। তিনিই আমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। মনে হলো, এটি শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে টিআইবি বেশ ভালো কাজ করছে। আমি মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তিনিও সম্মতি দিয়ে দিলেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআই বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত একটি অ-লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এর অবকাঠামো গড়ে উঠেছে বলে সংস্থাটি দাবি করেছে। টিআই সংগঠন সম্পর্কে বলা হয় যে, এটি বিশ্বব্যাপী সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনবরত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অর্থাৎ টিআই-এর প্রধান কাজই হচ্ছে পৃথিবী থেকে দুর্নীতিকে সমূলে উৎখাত করা। সে কারণে দুর্নীতি নিয়েই আমি তাঁকে প্রশ্ন করার বিষয়ে উৎসাহী হলাম।

প্রথম প্রশ্নটি ছিল এমন, বাংলাদেশে যে ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, সরকারের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি-না। এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলাম।

পিটার ইগেন যেটি বললেন, তার সারমর্ম হলো : কেবলমাত্র সরকারের পক্ষে এককভাবে কোনো দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তিনি বলেন, আমি মনে করি বেশিরভাগ দেশের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে নাগরিক সমাজ (সিভিল সোসাইটি) ও বেসরকারি খাতকে নিয়ে সরকার একসঙ্গে কাজ করবে। এই ত্রিভুজীয় ব্যবস্থাটি (সরকার, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাত) দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য খুবই দরকারি। তিনি ‘দুর্নীতি’-কে একটি দেশের প্রধান রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, সবার আগে সরকারকে ‘রাজনৈতিক শত্রু’ চিহ্নিত করতে হবে। তারপর এটি নির্মূলে উদ্যোগ নিতে হবে। 

বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়ে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান প্রসঙ্গেও তিনি মন্তব্য দেন। টিআই-এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছেন। তিনি দেশের আইন, বিধিবিধান এবং রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের চেষ্টাও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) করেছেন। এখন আমরা যদি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর সঙ্গে নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি খাতকে একত্রিত করি, তাহলে কিছু একটা (পরিবর্তন) হতেও পারে। 

দুর্নীতির ভয়াল থাবা থেকে বিশ্বকে রক্ষার জন্য ১৯৯৩ সালে প্রফেসর পিটার ইগেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আর ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে টিআই-এর চ্যাপ্টার হিসেবে টিআইবি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। টিআই-এর ইএ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মনে করেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে তার সংস্থা যে ধরনের কাজ করছে সেটিরও একটি সুফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ খুব ভাগ্যবান যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একটি শক্তিশালী চ্যাপ্টার (টিআইবি) সেখানে কাজ করছে। সেখানে চমৎকার নেতৃত্ব রয়েছে, যার মাধ্যমে আপনারা প্রায় দশ হাজার সমর্থক (সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য, ইয়েস মেম্বার ও স্বেচ্ছাসেবী) পেয়েছেন, যারা কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের সচেতন করার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সেখানে টিআইবি নানাভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশল ও পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, এই যে টিআইবি যা করছে-এটিও এক ধরনের প্রতিরোধ। আমি বলতে চাই, এককভাবে (সরকারের) যুদ্ধ করার চেয়ে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এই ধরনের সম্মিলিত উদ্যোগ দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেক বেশি কার্যকর উপায় হতে পারে।

তবে এই সম্মিলিত উদ্যোগই যে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে শেষ কথা সেটিও মনে করেন না বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত এই অধ্যাপক। তিনি ইউনিভার্সিটিজ অব ফ্রাঙ্কফুর্ট মেইন, জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্মেন্ট, হার্ভার্ড, জন হপকিন্সসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়িয়েছেন। ২০০২ সাল থেকে তিনি ‘সম্মানীয় অধ্যাপক’ হিসেবে বার্লিনের ফ্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছেন। সে কারণে তার মন্তব্যে মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মত রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়গুলো উঠে আসে।

প্রফেসর ইগেন বলেন, দেখুন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, দুর্নীতি মোকাবিলায় আপনাকে সামগ্রিক উদ্যোগ নিতে হবে। সুতারাং আপনি এক বা দুটি সরঞ্জাম খুঁজে বের করার চেয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন, প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য ব্যবস্থাটি গ্রহণ করবেন। তবে আমার মতামত হচ্ছে, বেশিরভাগ দেশেই দুর্নীতি মোকাবিলায় সরকার যে যন্ত্রগুলো কাজে লাগায় সেখানে পদ্ধতিগত সমস্যা থাকে। এসব ক্ষেত্রে তারা হয়তো সামগ্রিকভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়। আমি মনে করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তখনই সাফল্য আসবে, যখন আপনি নাগরিক সমাজকে তার স্বরে কথা বলতে দেবেন। সামাজিক সংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হয়রানি বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে প্রচারকাজ চালাতে দেবেন। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই কেবল আপনি (দুর্নীতির বিরুদ্ধে) কিছু অর্জনের কথা ভাবতে পারেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ এই ব্যক্তিত্বকে ২০০৪ সালে রিডার্স ডাইজেস্ট অ্যাওয়ার্ড            ‘ইউরোপিয়ান অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা প্রদান করে এবং ২০০৭ সালে তিনি গুস্তাভ হেইনমেন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে তিনি আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকাতেও কাজ করেছেন। প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে দুর্নীতি নির্মূলে সরকার যে ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সেটি যথেষ্ট কি-না? অথবা এইক্ষেত্রে সরকার কী ধরনের সংস্কার হাতে নিতে পারে? এই প্রশ্নে তাঁকে কিছুটা ক্ষুব্ধ মনে হলো। তিনি জানান, দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমের কারণে বাংলাদেশে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের চ্যাপ্টারটি বন্ধ করে দেওয়া প্রচেষ্টা ছিল। এমন কী সংসদ অবমাননার অভিযোগও তোলা হয়েছিল। যদি কেউ সংসদের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করে আর আপনি তার কণ্ঠরোধ করেন, আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলেন, তবে মুক্ত আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। যখন আপনি জনগণকে সরকারের সমালোচনার সুযোগ দেবেন না, তখন আপনি সেখানে প্রকৃত সংস্কার আশা করতে পারেন না। তাই এই অর্থে আমি কিছুটা হতাশ যে, গণতন্ত্রের কিছু মৌলিক বিষয় পুরোপুরি অনুমোদিত নয় সেখানে, যাতে করে দুর্নীতিবিরোধী একটি ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। তাঁর মতে, বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে নেওয়া উদ্যোগগুলো তাঁর কাছে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হয়নি। এ জন্য তিনি সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেছেন। 

তাহলে সুশাসনের জন্য এখন কী করা উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে পিটার ইগেন বলেন, দেখুন, এটি এমন একটি বিষয় যে ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ এবং বাংলাদেশের জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  এবং এ জন্যই সরকারকে নাগরিক সমাজ, সামাজিক সংগঠনগুলোকে সমাজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে, যাতে করে তাদের সংস্কৃতিতে কী ধরনের ভুল, তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কী ধরনের ভুল, তাদের                 বিধি-বিধানে কী ধরনের ভুল রয়েছে- সেগুলো তারা নিজেরাই পর্যালোচনা করতে পারে। এবং সেই পর্যালোচনা থেকেই আপনি সংস্কারের সুপারিশমালা পেয়ে যেতে পারেন।

তাই সুশাসনের জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার সে বিষয়ে বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) মতো প্রতিষ্ঠান নয়। টিআই-এর সদর দফতর বার্লিন এই সিদ্ধান্ত দেবে না।

সর্বশেষ খবর