শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
কাজী আসমা আজমেরী

বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে প্রথম শত দেশ

সমস্ত সরকার

বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে প্রথম শত দেশ
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সবুজ রঙের পাসপোর্ট নিয়ে শততম দেশ ভ্রমণের ইতিহাস গড়লেন কাজী আসমা আজমেরী। ১০ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে (গত ২৯ অক্টোবর ২০১৮) উজবেকিস্তান সীমান্ত থেকে দাশোগুজ দিয়ে তুর্কমেনিস্তানে পৌঁছে শততমদেশে পা রাখেন তিনি। শততম দেশ ভ্রমণ করার আনন্দ-উল্লাস বয়ে চলছে তার দেহ মনজুড়ে।

 

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সবুজ রঙের পাসপোর্ট নিয়ে শততম দেশ ভ্রমণের ইতিহাস গড়লেন কাজী আসমা আজমেরী। ১০ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে (গত ২৯ অক্টোবর ২০১৮) উজবেকিস্তান সীমান্ত থেকে দাশোগুজ দিয়ে তুর্কমেনিস্তানে পৌঁছে শততম দেশে পা রাখেন তিনি। শততম দেশ ভ্রমণ করার আনন্দ-উল্লাস বয়ে চলছে তার দেহ মনজুড়ে।

কাজী আসমা আজমেরীর কাছে শততম দেশভ্রমণ করার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বললেন, ‘১০০তম দেশভ্রমণ আমার স্বপ্ন ছিল। আজ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি খুব আনন্দিত। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশ ঘুরেছে অনেকেই তার মধ্যে কেউ ফ্ল্যাগ বয় ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি পেয়েছেন। আমি কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ১০০টি দেশ ভ্রমণ করলাম। আমার শততম দেশ ভ্রমণ তুর্কিমিনিস্তানের স্ট্যাম্প দিয়ে পূরণ করলাম। এটা আমার জন্য গৌরবের বিষয়। ২৯ অক্টোবর স্মরণীয় একটা দিন। এই দিনটির জন্য দীর্ঘ দশ বছর ধরে লালন করেছি। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ আমার জন্য প্রায়ই অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমিও কম নাছোড়বান্দা নই, অসম্ভবকে সম্ভব করে আমার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ মা-বাবার প্রতি ও যাদের সহযোগিতা আমার শততম দেশ ভ্রমণ। এ জয় শুধু আমার নয়, আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের মানুষের জয়। আমি পেরেছি বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্বের ১০০ দেশে পৌঁছে দিতে। প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের ছাপ রেখে এসেছি। আমার এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, আমি চাই বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে।’

কাজী আসমা আজমেরী ২০০৮ সাল থেকে দেশভ্রমণ করতে শুরু করেন। দেশ ভ্রমণ কীভাবে শুরু হলো জানতে চাইলে কাজী আসমা আজমেরী বলেন, ‘ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম। একদিন স্কুল ছুটির পর মা নিতে এলেন না। অবশেষে আমি একাই সাহস করে বাসার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটছি আর তাকিয়ে দেখছি আকাশটাকে। আকাশ দেখে মনে হলো, আকাশের শেষ সীমানা দেখব। কিন্তু আকাশের শেষ সীমানা আর দেখা পায় না। সেদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হাঁটছিলাম। পরে খুলনা কাজীবাড়ির ছোট্ট মেয়ে আমাকে দেখে এলাকাবাসী ধরে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেন। তারপর থেকে দেশ ভ্রমণ করার ইচ্ছাটা লালন করি। আকাশের সীমানা খুঁজে চলেছি। যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন আমার এক বন্ধুর মা আমাকে বলেছিলেন, তুমি একজন দুর্বল ও যোগ্যতাহীন মেয়ে। আমার ছেলে ২০ দেশ ঘুরেছে। আর তুমি মাত্র দুটো দেশ ঘুরেছ। এতেই তোমার অহঙ্কার। বন্ধুর মায়ের কথাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। আমিও দেশ ভ্রমণ করে দেখিয়ে দেব।  কমপক্ষে ৫০টি দেশ ঘুরব। ৫০টি দেশ ভ্রমণ করে থেমে থাকিনি। আমি ঘুরছি। আজ আমি শততম দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছি। ইচ্ছা আছে পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণ করব।’

কাজী আসমা আজমেরী বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের কত না ঘটনা কত না স্মৃতি তার ঝুলিতে। কখন আনন্দের কখন বেদনার। কিছু কিছু দেশে গিয়ে তার অনেক ভোগান্তি হয়েছে, বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বকে ঘুরে ঘুরে দেখার ঐকান্তিক সাধনায় তিনি পিছিয়ে পড়েননি। ২০০৯ সালে ভিয়েতনাম ভ্রমণে গিয়ে ফিরতি টিকিট না থাকায় তাকে ২৩ ঘণ্টা জেলে আটকিয়ে রাখা হয়। তারপর ২০১৪ সালে ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে মানিব্যাগসহ ব্যাংকের কার্ড অনেক কিছু চুরি হয়ে গিয়েছিল। তখন বেশ কয়েকদিন টাকার অভাবে খাওয়ার কষ্ট হয়েছিল তার।

আসমা ছোটবেলা থেকেই খেতে খুব পছন্দ করেন। দেশে ভ্রমণে তিনি বিভিন্ন দেশের প্রতিনিয়ত প্রায় নতুন নতুন খাবার খান। অদ্ভুত রকমের খাবারগুলো বেশি খেয়ে থাকেন। এর মধ্যে তিনি জানান, জর্জিয়ার কিংকালি তার প্রিয় খাবারের একটি। এ ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাবারের মধ্যে একটি চায়নার অ্যাবালন ফুড। ভারতের জয়পুরের ফালাক। অস্ট্রেলিয়ার পর্ন কোকটেন।

কাজী আসমা আজমেরীর বাবা বলেছিলেন, দেশে যাবে। সে দেশে গিয়ে আগে জাতীয় জাদুঘর দেখবে। আসমা তাই করেন। যে দেশে যান, সে দেশে প্রথমেই জাদুঘর দেখেন। জাদুঘর দেখলে তিনি সে দেশের সংস্কৃতি সম্পর্ক ধারণা পেয়ে যান। পৃথিবীর অসংখ্য জাদুঘর দেখেছেন ভালো লেগেছে শিকাগোর ফিল্ডং জাদুঘর? বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জাদুঘর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ হারমিটেজ। সেখানে গিয়ে তিন বন্ধু একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়ার বন্ধু মার্ক ও সুইডেনের বন্ধু টয়।

কাজী আসমা মিসরীয় পিরামিড থেকে শুরু করে মরক্কোর ইবনে বতুতার বাড়ি, বার্লির সেভেন উন্টার গ্রেট ওয়ান। ফ্রান্সের প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার। স্ট্যাট অব লিবার্টিসহ বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য দেখেছেন। তার ছবির অ্যালবামও রয়েছে। কাজী আসমা আজমেরী কয়েক বছর ধরে নিউজিল্যান্ডের রেড ক্রসে কাজ করেছেন। তিনি একজন রোটারিয়ানও। সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িত রেখেছেন।

কাজী আসমা আজমেরী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর ২০১৮ সালে বিবিসি বাংলা প্রতুষা অনুষ্ঠানে তার সাক্ষাৎকার প্রচার হয়। ২০১৫ সালে ভয়েস অব আমেরিকার চোখে পড়েন আসমা। ভয়েস অব আমেরিকার আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন ডিসিতে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন। এরপর ২০১৫-২০১৬ সালে বিভিন্ন বাংলাদেশি টিভিতে অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বলেছেন তার ভ্রমণের কথা। এ ছাড়াও চায়না রেডিও ও বেতার বাংলা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশি পর্যটক হিসেবে। উজবেকিস্তানের মাইটিভি এবং তুর্কেমেনিস্তানের ন্যাশনাল নিউজ পেপার তুর্কিস্তানে তার ১০০টি দেশে পদার্পণের সংবাদ প্রকাশিত হয়।

কাজী আসমা আজমেরী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে-  বাংলাদেশি অ্যাম্বাসির আমন্ত্রণে গিয়েছেন। সর্বশেষ তিনি গত ২৪ অক্টোবর ২০১৮ সালে ৯৯ দেশ ভ্রমণ হিসেবে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে উদযাপন করেন। সেখানে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের সফলতার দেশ হিসেবে তিনি অতিথি বক্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। উদযাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর এক্সট্রাঅর্ডিনারি মাসুদ মান্নান। ভারতের অ্যাম্বাসেডর, বুলগেরিয়ার অ্যাম্বাসেডর, আলবেনিয়ার অ্যাম্বাসেডর, জর্জিয়ার অ্যাম্বাসেডর, জর্ডানের অ্যাম্বাসেডরসহ অনেকে। তিনি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে অবস্থান করছেন। খুব শিগগির বাংলাদেশে আসবেন।

আসমা জন্মগ্রহণ করেন খুলনার বিখ্যাত কাজী পরিবারে। বড় হয়েছেন খুলনা শহরে। তার বাবার নাম কাজী গোলাম কিবরিয়া। মায়ের নাম কাজী সাহিদা আহমেদ। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে কাজী আসমা আজমেরী।

আসমা বড় ইকবালনগর গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে (বিবিএ) মার্কেটিংয়ে স্নাতক করেন। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে একই বিষয়ে এমবিএ করেন।

কাজী আসমা আজমেরী দেশে ফিরে ১০০টি দেশ ভ্রমণ শেষে নিজের অভিজ্ঞতার কথা গণমাধ্যমে বর্ণনা করবেন।

এ ছাড়া মানবিক দিক বিবেচনা করে দেশে ফিরে তিনি একটি চক্ষু হাসপাতাল, একটি ডেন্টাল হাসপাতাল ও একটি ট্রেনিং সেন্টার এবং একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় হাত দেবেন। পাশাপাশি দুস্থ অসহায় মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আজীবন তাদের পাশে থাকতে চান বাংলাদেশের ইবনে বতুতা খ্যাত কাজী আসমা আজমেরী। এ ছাড়াও ভিসা জটিলতা আর বিভিন্ন এক্সপেরিয়েন্স থেকে তিনি চিন্তা করেছেন যে, গড়ে তুলতে চান বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং হেল্পলাইন সেন্টার যাতে কোনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট হোল্ডার কোথাও সমস্যার মুখোমুখি হলে তিনি সহায়তা করতে পারেন। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে কারও যেন ভোগান্তিতে না পড়তে হয়। বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে যেন বিদেশিরা সম্মান করেন। আসমাকে দেখে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অনেকে যেন ভ্রমণ করতে উৎসাহিত হন। জয় হোক আসমার, জয় হোক বাংলাদেশের, জয় হোক বাংলাদেশের পাসপোর্টের।

সর্বশেষ খবর