শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিবিসির অনুপ্রেরণীয় তালিকায় হৃদয়ের মা

শনিবারের সকাল ডেস্ক

বিবিসির অনুপ্রেরণীয় তালিকায় হৃদয়ের মা
সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে তাকে পড়াশোনা করানো, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এমনকি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিরূপণে বাবা-মায়ের থাকে উদ্বেগ। তবে সন্তানের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেই উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় আরও অনেক বেশি। অনেক বাবা-মা প্রতিবন্ধী সন্তানকে পৃথিবীর কর্মযজ্ঞ থেকেও দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। তবে দমে যাওয়ার মানুষ নন হৃদয় সরকারের বাবা-মা। তারা চেয়েছেন, সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। আর সেজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে হৃদয়ের মাকে। স্বীকৃতি হিসেবে বিবিসি অনলাইন জরিপে হৃদয়ের মা হয়েছেন অনুপ্রেরণীয়।

 

 

প্রতিবছর গোটা বিশ্বের বিজ্ঞান, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন অঙ্গনের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করে বিবিসি। এই রীতি অনুযায়ী বিবিসি অনলাইন ২০১৮ সালের সেরা অনুপ্রেরণাদানকারী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে ১৭ নভেম্বর। বিবিসির এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশি সীমা সরকার। তিনি নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে হৃদয় সরকারকে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিজের কোলে করে যাতায়াত করিয়েছেন। এ বছর উদ্যমী এই মায়ের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ‘খ’ ইউনিটে ভর্র্তির সুযোগ পেয়েছেন। মায়ের কোলে উঠেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান হৃদয়।

বিবিসির ১০০ জন নারীর এই তালিকায় ৮১তম স্থান পেয়েছেন সীমা সরকার। বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী নারীদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব নারী সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে সাহসিকতা ও উদ্যমের পরিচয় দিয়ে থাকেন। বিবিসির করা সম্মানজনক এই তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মেয়ে চেলসি ক্লিনটন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও পাকিস্তান থেকে প্রথম হিন্দু নারী সিনেটর কৃষ্ণকুমারীর মতো নারী। চেলসি ২০, গিলার্ড ৩৬ ও কৃষ্ণকুমারী ৪৮তম অবস্থানে আছেন। এই তালিকায় সবার ওপরে স্থান পেয়েছেন নাইজেরিয়ার সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা উদ্যোক্তা ৩৩ বছর বয়সী আবিসোয়ে আজেয়ি আকিনফোলারিন। তার পরে আছেন যথাক্রমে বাহরাইনের এসরা আল সাফেই ও রাশিয়ার এসভেতলানা আলেকসিভা। এসরা আল সাফেই অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। রাশিয়ার এসভেতলানা আলেকসিভা একজন পেশাদার মডেল।

চলতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিন হৃদয় আসেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে। যথারীতি সেদিনও মা সীমা সরকারের কোলে চড়ে পরীক্ষার হলে যেতে হয় হৃদয় সরকারের। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এতদূর আসা সুস্থ সবলদের জন্য অবশ্যই অনুপ্রেরণাদানকারী। আর তাই অনুপ্রেরণাদায়ী এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেন। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে ছড়িয়ে পড়ে ছবিটি। ওই ছবিতে দেখা যায়, হৃদয় সরকারকে কোলে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল থেকে পরীক্ষার হলের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তার মা।

২৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার হৃদয় সরকারের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। সেখানে ২ হাজার ৩৭৮টি আসনের বিপরীতে ৪ হাজার ৭৪৭ জন ভর্তিচ্ছুকে উত্তীর্ণ হিসেবে রাখা হয়। ওই তালিকায় হৃদয় ৩ হাজার ৭৪০তম অবস্থান অর্জন করেন। পরীক্ষায় হৃদয় সরকার বাংলা অংশে ৯ দশমিক ৩০, ইংরেজি অংশে ১৪ দশমিক ৪০ ও সাধারণ জ্ঞান অংশে ২৭ দশমিক ৯০ নম্বরসহ মোট ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পেয়ে ৩ হাজার ৭৪০তম স্থানের অধিকারী হন। কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায়। হৃদয় আবেদনের সময় নিজেকে প্রতিবন্ধীর কোটায় রেখে আবেদন করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী দৃষ্টি, শ্রবণ অথবা বাকপ্রতিবন্ধী হতে হবে। হৃদয় ছিলেন সেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধী। এই হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়ের ভর্তির ব্যাপারটি প্রায় অনিশ্চিতের মধ্যে পড়ে যায়। এত দিনে এত কষ্ট, শ্রম, আশা আকাক্সক্ষা যেন নিমিষেই মিলিয়ে যেতে লাগল। দারুণভাবে ভেঙে পড়েন হৃদয় ও তার পরিবার। কিন্তু এমন সময় আবার তাদের পাশে এসে দাঁড়াল গণমাধ্যম। এ নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রতিবেদন।

 

প্রতিবেদনে বেশ সাড়া পড়ে যায়। বিষয়টি নজরে আসে ঊর্ধ্বতনের। তখন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতনরা প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার আনা হয়। এতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ তৈরি হয় হৃদয় সরকারের। এখন থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী অন্য শিক্ষার্থীরা এই কোটার আওতায় ভর্তির সুযোগ পাবেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘যুগের চাহিদা মেটানো ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য আমরা আমাদের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার এনেছি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দৃষ্টি, শ্রবণ আর বাকপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবন্ধী কোটা প্রযোজ্য ছিল। এর সঙ্গে বর্তমানে আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও যুক্ত করেছি। এতে করে ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছেলেমেয়েরা মেধার স্বাক্ষর রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে। অবস্থা দৃষ্টে বাস্তবতার নিরিখে এই সংস্কার করা হয়েছে।’ হৃদয় সরকারের মা সীমা সরকার পেশায় একজন গৃহিণী। হৃদয়রা দুই ভাই। তার বাবা সমীরণ সরকার নেত্রকোনার একটি ব্রিকফিল্ডের ম্যানেজার। নেত্রকোনা শহরেই থাকেন তারা।

ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও মা চেয়েছিলেন হৃদয় লেখাপড়া শিখে উচ্চ শিক্ষিত হোক। তাই স্কুল ও কলেজসহ সব জায়গাতে মা সীমা সরকারই তাকে নিয়ে যেতেন। কখনো তিন-চার তলায় হৃদয়ের পরীক্ষার সিট পড়েছে। তখন তার মা হৃদয়কে কোলে করে পরীক্ষার হলে নিয়ে  গেছেন। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায়ই রিকশা পাওয়া যেত না। হয়তো সময়ও থাকত খুব কম। তখন হৃদয়ের মা প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের স্কুলেও নিয়ে গেছেন। এক কথায় বলতে গেলে মায়ের কোলে চড়েই হৃদয় সরকার এই পর্যন্ত এসেছেন। হৃদয়ের মায়ের মতো করে অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন না, শারীরিকভাবে এমন অযোগ্য ছেলের পক্ষে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু হৃদয় আর হৃদয়ের মা সীমা সরকার তা বাস্তবে পরিণত করেছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সব কৃতিত্ব হৃদয় তার মাকেই দিয়েছে। বিবিসির জরিপে বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর মধ্যে নিজের মায়ের নাম দেখে দারুণ খুশি হৃদয়। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে তার মা এক অনন্য স্বীকৃতি পেলেন।

হৃদয় বলেন, ‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসী আমার জন্য মায়ের অবদানের কথা জানতে পারবে। বিশ্বের সব মা তার সন্তানকে লেখাপড়া করাতে অনুপ্রেরণা দেবে।’

চলতি বছর নেত্রকোনার আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ ৪.৫০  পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন হৃদয়। এসএসসি পরীক্ষায় নেত্রকোনা জেলা স্কুল থেকে জিপিএ ৪.০৬ পেয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হৃদয় সরকার। দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন না। যে নারীর অনুপ্রেরণা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় এতসব সম্ভব হয়েছে, সেই মায়ের জন্যই বড় হতে চান হৃদয় সরকার। নিজের মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চান হৃদয়। তার মায়ের মতো সবাই তাদের সন্তানকে লেখাপড়ায় সাহায্য করুক এই প্রত্যাশা করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কৃতিত্ব মাকেই দিয়েছেন হৃদয়। এ বিষয়ে হৃদয় বলেন, আমার এ ফলাফলের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার মায়ের। সেই ছোট থেকেই তিনি আমাকে কোলে করে স্কুল-কলেজে নিয়ে যান। মা তাকে কোনোদিন হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে  দেননি। হৃদয়ের মা সব সময় বলেন, যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, যতদিন সামর্থ্যে কুলায়, তিনি ছেলেকে কোলে করেই নিয়ে যাবেন। হৃদয়ের এ ফলাফলে দারুণ খুশি তার পরিবার। হৃদয় বলেন, বাবা-মা অত্যন্ত খুশি হয়েছেন, তাদের সব কষ্ট আজ সার্থক হয়েছে।

 

 

বিবিসির অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন হৃদয় সরকারের মা সীমা সরকার।

হৃদয়ের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটায় পরিবর্তন আনা হয়। এখন থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা এই কোটার অধীনে ভর্তি হতে পারবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সব কৃতিত্ব হৃদয় তার মাকেই দিয়েছেন।

১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর মধ্যে নিজের মায়ের নাম দেখে দারুণ খুশি হৃদয়।

সর্বশেষ খবর