শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কার্টুন এঁকে বিশ্ব কাঁপানো মোর্শেদ মিশু

কার্টুন এঁকে বিশ্ব কাঁপানো  মোর্শেদ মিশু
চলমান পৃথিবীর নানান যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাতে আহত ও নিহত মানুষদের নির্মমতার ছবি নাড়িয়ে তোলে কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো ছবিগুলো এড়িয়ে যেতেন বারবার। সেখান থেকেই ভিন্ন দৃষ্টি নিয়ে ছবিগুলো দেখতে চাইলেন মিশু। যুদ্ধাক্রান্ত নির্দোষ মানুষেরা যদি সংঘাতের মুখোমুখি না হতেন, কেমন হতে পারত সেই ছবিগুলো? সেখান থেকেই ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’ সিরিজটি আঁকতে শুরু করেছিলেন মিশু। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ছবিগুলো। দ্রুত বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়েন মিশু। এর মধ্যেই ভারত, ইরান, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইতালি, আলবেনিয়া, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ১৭টি দেশের মিডিয়ায় ওঠে এসেছে মিশুর এই সিরিজ। কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুর সঙ্গে কথা বলে   বিস্তারিত লিখেছেন- রণক ইকরাম

 

সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। চারপাশে ঘুরে বেড়ানো দুঃখের দৃশ্যগুলো দেখতে চায় না। দেখতে চায় সুখের ছবি। সেই চিন্তা থেকেই কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুর গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ সিরিজের জন্ম। কিন্তু কীভাবে এলো সেই আইডিয়া? মোর্শেদ মিশু বলেন, ‘খুব আয়োজনের কিছু ছিল না। বা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আইডিয়া করেছি- সেটিও না। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত কতগুলো ছবি দুয়েক মাস আগে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ছবিগুলো এতটাই মর্মান্তিক যে তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি সে ছবিগুলো এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু চোখ এড়িয়ে গেলে কী হবে। মাথায় থেকে তো হারায় না। এমনও হয়েছে এই ছবির কারণে আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আমার কেবল মনে হলো এমন কেন হচ্ছে? এমন ছবি তো আমরা কেউই দেখতে চাই না। তখনই মাথায় খেলল- তাহলে কী দেখতে চাই আমরা? আমরা সুখী মানুষ দেখতে চাই। এরপর একটা ছবি সামনে নিয়ে পাল্টে দিলাম কনসেপ্ট ও চারপাশ। দুর্দশার ছবিটাকেই সুখের ছবির রূপ দিলাম। এভাবেই জন্ম হলো এই সিরিজের প্রথম ছবি।’

মিশুর এই যাত্রায় সঙ্গী হন ছড়াকার অনিক খান। মিশুর ভাষায়- ‘প্রথম ছবিটা আঁকা শেষ করেই অনিক ভাইকে নক করলাম সিরিজটার একটা নাম আর দুই লাইন ছড়ার জন্য। তখনই অনিক ভাই দুই লাইনে বললেন ‘আমি শুধু আঁকতে জানি, কষ্টগুলো ঢাকতে জানি’। সেই সঙ্গে দুজন কথা বলে এই সিরিজটার নাম নির্ধারণ করি ‘দি গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’। পরবর্তীতে অনিক খানসহ দেশ বিদেশের অনেকেই আমাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে।’

সেখান থেকেই ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’ সিরিজটি আঁকতে শুরু করেছিলেন মিশু। সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ছবিগুলো। দ্রুত বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়েন মিশু। এর মধ্যেই ভারত, ইরান, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইতালি, আলবেনিয়া, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ১৭টি দেশের মিডিয়ায় ওঠে এসেছে মিশুর এই সিরিজ।

বিদেশি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ প্রসঙ্গে মিশু বলেন, ‘সবার কাছ থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছি। অনেকগুলো কাগজেরই একটা অক্ষরও পড়তে পারছি না। কিন্তু নিশ্চয়ই তারা ভালো কথাই বলেছেন। তবে সবচেয়ে বড় পাওয়া তারা এই ব্যাপারটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন।’ বিদেশি গণমাধ্যমের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে মিশুর। কী জানতে চেয়েছে তারা? মিশু বলেন, ‘অনেকে অনেক কিছু জানতে চাইলেও সবাই আমার পলিটিক্যাল বেইজ জানতে চেয়েছে। কেন এটায় আগ্রহ হলো সেটি জানতে চেয়েছে। আমি সবাইকে একটা কথাই বলেছি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক চেতনা থেকে আমি এটা করিনি। এত ওয়ার ভিক্টিমের দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করতে পারিনি বলেই এই ছবিগুলোতে সুখ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।’ একই সিরিজের আরও ছবি আসছে বলেও জানান মিশু।

কিন্তু কষ্টের ছবিকে হ্যাপিনেসের রূপ দিলেই কি কষ্ট ঢাকা যায়? মিশু বলেন, ‘আসলে এভাবে হ্যাপিনেস এঁকে তো আর কষ্ট ঢাকা যায় না। বরঞ্চ আঁকা ছবিগুলো মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। এরপরও সবার দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টানো জরুরি। এতসব কষ্টের মধ্য থেকে সুখ বের করে আনার চেষ্টাই একদিন গ্লোবাল হ্যাপিনেস তৈরি করবে। ’

 

স্কুলজীবনে ভালো ক্রিকেট খেলতেন মিশু। ক্রিকেটের মতো অতটা ভালো না খেললেও ফুটবলটা চালিয়ে নিতেন গোলকিপিং। স্কুলজীবন শেষ করে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে পড়তে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ওসব কিছু ছাপিয়ে মিশুকে বিশ্ব এখন চেনে কার্টুনিস্ট হিসেবেই। কিন্তু কীভাবে এলেন আঁকাআঁকির এমন রাজ্যে?

মিশুর আঁকাআঁকির শুরু তার মেজো ভাই মাহিন আবদুল্লাহ। ছোটোবেলায় মেজো ভাই উন্মাদ ম্যাগাজিন, চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকি, নন্টে-ফন্টে এনে দিতেন। সেগুলো পড়তে ভালো লাগত মিশুর। আর পড়া শেষে দুই ভাই মিলে কমিকদের অণুকরণে আঁকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ভাইয়ের ছবি যত সুন্দর হতো মিশুর আঁকা ততটাই বাজে হতো। মিশুর ভাষায়- ‘আমার আঁকা ভালো হতো না বলে রীতিমতো কেঁদে দিতাম। ছোটোবেলায় খুব ছিঁচকাদুনে ছিলাম। তখন ভাইয়া অনেক কিছু শিখিয়েছে। এরপর আমিও টুকটুক করে খানিকটা আঁকতে শিখে গেছি। সব সময় কমিকস আর গল্প উপন্যাসে ভেসে বেড়ানো চরিত্রগুলোকে আমার আঁকায় জীবন্ত করতে চেয়েছি। এরপর ২০১২ সালে আমার আঁকাআঁকির মোড় ঘুরে যায়। কারণ সে বছর আমার পরিচয় ঘটে দেশ সেরা কার্টুনিস্ট ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবিবের সঙ্গে। এরপর উন্মাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি।’

 

এর মধ্যেই দীর্ঘদিন থেকে পালন করছেন দেশের একমাত্র স্যাটায়ার ম্যাগাজিন উন্মাদ এর সহ সম্পাদকের দায়িত্ব। বিভিন্ন পত্রিকার জন্য এঁকেছেন, করেছেন বইয়ের প্রচ্ছদও। তার আঁকা কার্টুন প্রদর্শিত হয়েছে দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও। এসবের মাঝে বেশ কিছুদিন এজেন্সিতে চাকরিও করেছেন। জীবন নিয়ে কী ভাবনা আঁকিয়ে মিশুর? হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি ভাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবী না। টাকা আমাকে ওভাবে টানে না। নিজের মতো তাকে ভালোবাসি। আঁকতে ভালোবাসি। মাঝখানে এজেন্সিতে চাকরি করেছি অভিজ্ঞতার জন্য। আদৌ আমাকে দিয়ে হবে কি না ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য?’

সেখানে কাজ করে কী ফল পেলেন মিশু? ‘জীবনে সব অভিজ্ঞতারই দাম আছে। এই অভিজ্ঞতাও মন্দ ছিল না। কিন্তু আমি আসলে নিয়মের মধ্যে বাঁধা পড়তে চাইনি। তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।’

 

এর মধ্যেই উন্মাদের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে সবার কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে। আর এই কার্টুন সিরিজটি উন্মাদ উৎসবে জিতেছিল ‘উন্মাদ কার্টুন উৎসব’-এর প্রথম পুরস্কার।

মিশুর বিশ্বাস কার্টুন প্রতিবাদের অনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা। এই ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এটি সার্বজনীন। সমগ্র বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষই এর ভাষা বুঝতে পারে। আর এ কারণেই কার্টুন হয়ে উঠতে পারে বৈশ্বিক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

 

 

 

গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ

গোটা সিরিজের কনসেপ্ট ‘আমি শুধু আঁকতে জানি- কষ্টগুলো ঢাকতে জানি।’ কিসের কষ্ট? পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ লেগে আছে। সেই যুদ্ধে ক্ষতির সম্মুখীন হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের হাজার হাজার ছবি আমাদের সামনে আসে। ওইসব ছবিতে থাকে কষ্ট-আহাজারি। কিন্তু মানুষ কি কষ্ট পেতে চায় না। চায় সুখে থাকতে। সেখান থেকেই যুদ্ধের ছবিকে হ্যাপিনেসে রূপ দিয়েছেন মিশু। ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’ সিরিজের ৯টি ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। নিচে সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় ছবিটি রয়েছে। বামের ছবিতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। আর ডানের ছবিতে একই ছবির হ্যাপিনেস রূপ ফুটে ওঠেছে মিশুর আঁকায়।

সর্বশেষ খবর