শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিতাই চন্দ্র রায়

কৃষকের বন্ধু ফসলের বন্ধু

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

কৃষকের বন্ধু ফসলের বন্ধু
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করেন তিনি। তারপর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন চিনিকলে দীর্ঘ ৩২ বছর চাকরি করেছেন। অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি। শেষ জীবনে নাটোর জেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ছিলেন মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)। চাকরি শেষ করে ফিরলেন বাড়িতে। তবে ৬০ বছরের এই জীবনে তিনি এখনো বসে নেই। ছুটেন সবুজের প্রান্তরে প্রান্তরে।

 

নিতাই চন্দ্র রায়। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। বেশ লম্বা। পোশাক বেশ পরিপাটি। কথা-বার্তায়ও মার্জিত। বয়স ষাট বছর। আসল নাম নিতাই হলেও তিনি এখন নানা নামে পরিচিত। সাদামাটা এই ভদ্রলোকটি কারও কাছে কৃষকের বন্ধু, কারও কাছে আবার শর্সের বন্ধু। কিন্তু সবার কাছেই তিনি একজন পরিপাটি সাদা মনের মানুষ। অসাধারণ মানুষটির সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী আলাপচারিতায় মনে হলো তিনি আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞ চিকিৎসক। তবে মানুষের নন, শষ্য মাঠের চিকিৎসক। যতক্ষণ ঘরের বাইরে থাকেন ততক্ষণই তিনি এক পকেটে ছোট প্যাড আর কলম নিয়ে টুকে যান ফসলি জমি এবং শষ্যের নানা সমস্যা। খুঁজে ফেরেন নানা সমস্যা এবং নানা সমাধান। তবে অন্য পকেটে অ্যান্ড্রোয়েট মোবাইল ফোনটিই দিব্যি দেখা যায়। এ নিয়েই প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা অব্দি ছুটে বেড়ান মাঠ থেকে মাঠে। ময়মনসিংহের ত্রিশালের এ গ্রাম ওই গ্রাম ঘুরে ঘুরে জানতে চেষ্টা করেন কোন ফসলের কী রোগ। যদি রোগের দেখা মেলে তাহলে ওই প্যাডে লিখে দেন ব্যবস্থাপত্র। আর সেই কৃষকের যদি স্মার্ট ফোন থাকে তাহলে নিজের মোবাইল থেকে শেয়ার করেন কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অ্যাপস।

 

ফসলের এই চিকিৎসকের আবার আরেকটি নিয়ম আছে। রোজ বিকালে নিয়ম করে উপজেলার বিভিন্ন কীটনাশকের দোকানে বসেন। সেখানে ফসলের সমস্যা নিয়ে আসা কৃষকদের ফসলের বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি এবং কীটনাশক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেন। এ ছাড়াও মোবাইল ফোনেও তিনি কৃষকদের পরামর্শ দেন বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে। অর্থাৎ ফসলের সেবার জন্য নিজের দুয়ার ২৪ ঘণ্টার জন্যই খোলা রেখেছেন। এসবের কারণে তিনি এখন পরিচিত ‘ফসলের চিকিৎসক’ নামেও।

 

কথা বলে জানা গেল তার জীবন সম্পর্কেও। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করেন তিনি। তারপর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন চিনিকলে দীর্ঘ ৩২ বছর চাকরি করেছেন। অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি। শেষ জীবনে নাটোর জেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ছিলেন মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)। চাকরি শেষ করে ফিরলেন বাড়িতে। তবে ৬০ বছরের এই জীবনে তিনি এখনো বসে নেই। ছুটেন সবুজের প্রান্তরে প্রান্তরে। নিতাই চন্দ্রের কাছে প্রশ্ন ছিল শেষ বয়সে বিশ্রামের পরিবর্তে কেন ফসলি দিগন্তে? একগাল হাসি দিয়ে বলেন, ‘এ নিয়ে পরিবারের বিস্তর অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। তাদের বলি, চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি কাজ থেকে নয়। আর কৃষকের পাশে দাঁড়ানো আমার পুরনো অভ্যাস। চাকরিকালীন সময়েও আশপাশের অনেক কৃষককে সেবা দিয়েছি। এখন যেহেতু অজস্র সময়, তাই ঘুরে ঘুরে দেখি ফসলি জমিগুলোর কী অবস্থা? সমস্যা থাকলে পরামর্শ দেই। আর এতে করে মানসিকভাবে যেমন ভালো থাকি তেমনি শারীরিক অবস্থাও আমার বয়সী যারা আছেন তাদের থেকে অনেক ভালো।’

 

একটি উদাহারণ দেওয়া যাক এই ফসলি চিকিৎসকের। একদিন সকালে বের হয়ে ত্রিশালের এক গ্রামে গিয়ে জানতে পারেন রইসুল ইসলাম নামের এক কৃষকের গাছের আম ঝরে যাচ্ছে ও যেগুলো গাছে আছে তাও ফেটে যাচ্ছে। তার বাড়িতে গিয়ে আরও অনেক সমস্যার কথা জানতে পারেন নিতাই। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন ব্রোন ও পটাশ সার প্রয়োগ করে আমগাছে নিয়মিত সেচ দেওয়ার। শুধু রইসুলই নয়, তার মতো অনেক কৃষকই এখন ফসলের এই চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। তেমনি আরেকদিন, স্থানীয় কোনাবাড়ি গ্রামের এক কৃষকের শসা খেতে পোকার আক্রমণ হয়েছে জানতে পারেন। ফসল সরাসরি পরখ করে দেখেন শসার পাতায় পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। তিনি জৈব বালাইনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে পোকা দমনের পরামর্শ দেন। এতে কাজও হয়।

 

অতি লোভীদের বিষয়ে নিতাই চন্দ্র বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বলেন, প্রান্তিক কৃষকরা কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কথা শুনে ফসলি জমিতে বেশি কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। কারণ এতে নাকি লাভ বেশি হবে। এতে করে সাময়িক উৎপাদন বেশি হতে পারে। কিন্তু ওই ফসলি জমির মাটি নষ্ট হয়, মাটির উপকারী জীবাণু মারা যায়, প্রকৃতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি সেই পানি প্রাকৃতিক জলাশয়ে গেলে মাছের উৎপাদনও ব্যহত হয়। 

 

শুধু ঘুরে ঘুরে ফসলের সেবা এবং পরামর্শ দেওয়াই নিতাই চন্দ্রের কাজ নয়। তিনি কৃষি নিয়ে আরও অনেক ধরনের কাজ করেন। লেখালিখি করেন

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে, ওয়েবসাইটে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দেন। অংশ নেন কৃষি সেবার বিভিন্ন কার্যক্রমে। কৃষকদের নিয়ে প্রায় সময়ই আয়োজন করেন মতবিনিময় সভার। কাজ করেন নগরবাসীর খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তায়। তার মতে, ৫০ ভাগ মানুষ এখন নগরে বাস করে। তাই গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরীর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। নিউজিল্যান্ড এবং কিউবায় ইতিমধ্যে নগর জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ফসলি চিকিৎসক নিতাই চন্দ্র রায়ের আরেকটি গুণও আছে। তিনি একজন কবিও। ছাত্রজীবন থেকেই রয়েছে তার লেখালেখির অভ্যাস। ‘নাচে জ্যোৎস্না, মায়াবী আগুন’ নামের একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থও ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে এই ফসলি চিকিৎসকের।

সর্বশেষ খবর