শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গাছবন্ধু ওয়াহিদ সরদার

শেখ রুহুল আমিন, ঝিনাইদহ

গাছবন্ধু ওয়াহিদ সরদার

বৃক্ষপ্রেমিক ওয়াহিদ সরদার নিজেই একজন আলোকিত মানুষ। তার এই বৃক্ষপ্রেম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার মানুষের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। গাছের প্রতি মানুষের মমত্ববোধকে তিনি জাগিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি ওয়াহিদ বেশ আলোচনা, প্রশংসার পাত্র হয়ে ওঠেছেন। তার সাইকেলের সামনে একটি সাইনবোর্ড বাঁধা। তাতে গাছে পেরেক মারার ক্ষতি বিষয়ে সতর্কবার্তা লেখা। সাইকেলের পেছনে থাকে কাঁথা-বালিশ। একটি বদনাও ঝোলানো। যেখানে সেখানে প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য এটা সঙ্গে নেওয়া। যশোর সদরসহ নানা জায়গায় ২০০৬ সাল থেকে ২০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন। যদিও এর মধ্যে ১৩ হাজার গাছ বেঁচে আছে। বৃক্ষের প্রতি এমন ভালোবাসার কারণেই ওয়াহিদ সরদার ঝিনাইদহের মানুষের কাছে একজন সচেতন মানুষ ও বৃক্ষপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় লাভ করেছেন।

 

শুরুর গল্প

গত রমজান মাস। রাত সাড়ে ১২টা হবে। সাড়াপোল বাজারে এক দোকানে মাইক বাজছিল। ঘুমাতে না পেরে সাড়াপোল মোড়ের একটি আমগাছের নিচে গিয়ে বসেছিলেন ওয়াহিদ। হঠাৎ শুনতে পেলেন কেউ বুঝি বলছে, ওয়াহিদ, গাছ তো অনেক লাগালে। এবার রক্ষার কাজটি করো। আনমনা ওয়াহিদ তখন গাছের গায়ে হাত বুলালেন। তখনই হাতে পেরেক বাঁধল। টর্চলাইট জ্বেলে দেখলেন গাছের গায়ে অনেক পেরেক। ব্যানার, সাইনবোর্ড লাগানোর পেরেক। কিছু কিছু গাছে লোহার তারও বাঁধা। পরদিনই যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে পেরেক ঠোকা বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেন। তিনি (প্রশাসক) একটি তালিকা চাইলেন। বন্ধু রব্বানিকে সঙ্গে নিয়ে সাড়াপোল থেকে চাঁচড়া পর্যন্ত এবং পুলেরহাট থেকে পলাশী পর্যন্ত সাইনবোর্ড মারা গাছের তালিকা তৈরি করেন ওয়াহিদ। তারপর নিজেই একই বছরের জুলাই মাসের ৪ তারিখ দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান পেরেক তোলার মিশন নিয়ে। শুরুর গল্প সম্পর্কে বলছিলেন গাছবন্ধু ওয়াহিদ সরদার। তিনি আরও বলেন, ‘শুরুর দিন যশোর টাউন হল ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ কোনার মেহগনি গাছ থেকে চারটি তারকাঁটা (পেরেক) তুলে কাজ শুরু করি। ওইদিনই সেখানের ১০-১২টি গাছ থেকে ৫০টির বেশি তারকাঁটা তুলি। তারপর যশোর কালেক্টরেট চত্বরে গিয়ে দেখি গজালও (বড় বড় তারকাঁটা) মারা গাছের গায়ে। বুঝতে পারি ছোট শাবল দিয়ে এগুলো তোলা সম্ভব নয়। তাই চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ জামাল সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি এক হাজার টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়ে ওইদিনই বিশেষ রকমের শাবল তৈরি করি।’

 

ঈদের দিনেও বাড়ি যাননি

প্রতিদিনই তার কর্মময় দিন। এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে পেরেক তোলেন ওয়াহিদ। পুলেরহাট থেকে রাজগঞ্জ হয়ে কেশবপুর উপজেলা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক, হাজারো গাছ সড়কটির দুই পাশে। গাছগুলোর গা থেকে পেরেক তোলেন তিনি। তারপর মঙ্গলকোট হয়ে পেরেক তুলতে তুলতে চলে যান সাতক্ষীরার চুকনগর বাজার পর্যন্ত। সেখান থেকে ফিরতি পথ ধরেন কেশবপুর হয়ে মনিরামপুর। পথে পথে পেরেক লাগানোর ক্ষতি বিষয়ে সচেতন করেন মানুষকে। বোঝানোর চেষ্টা করেন সবুজ বনায়নের গুরুত্ব। তাদের ব্যথা-বেদনার কথা। গেল কোরবানির ঈদের দুই দিন আগে ২০ আগস্ট সাইকেল নিয়ে আবার পথে নামেন ওয়াহিদ। কয়েকটি সড়কে জরিপ করেন। তারপর ২১ আগস্ট সকালে যশোরের ধর্মতলা থেকে পেরেক তুলতে তুলতে পতেঙ্গালী, নারাঙ্গালী বাজার হয়ে চলে যান কায়েমখোলা বাজার। পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কায়েমখোলা বাজারের এক দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপর হেড ল্যাম্প লাগিয়ে ওই রাতেই পেরেক তুলতে তুলতে যেতে থাকেন চৌগাছা। সারা রাত পেরেক তুলে ২২ আগস্ট ঈদুল আজহার দিন পৌঁছান চৌগাছা বাজারে। এক দোকানে চা, পাউরুটি খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপর আবার পেরেক তোলার কাজে লেগে যান। চৌগাছা বাজার থেকে পাকা সড়ক ধরে রওনা হন কোটচাঁদপুর। কোটচাঁদপুরে অবসরপ্রাপ্ত দারোগা আইয়ুব সাহেবের কাছে পৌঁছে ঈদের সেমাই খান। সামান্য বিরতি নিয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের পথ ধরেন। পেরেক তুলতে তুলতে পথে রাত গভীর হয়। চন্ডীপুর বাজারে নাইটগার্ডের সাহায্য নিয়ে এক চায়ের দোকানে রাত কাটান। পরদিন চলতে থাকেন ঝিনাইদহের দিকে। পথে কুঁড়েঘর বাজারে পৌঁছাতে রাত ৮টা বাজে। চা, বিস্কুট খেয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার পরের দিন ২৪ আগস্ট পেরেক তুলতে তুলতে সন্ধ্যা নামে। পৌঁছান ঝিনাইদহ শহরের গণপূর্ত বিভাগের সামনে। সেদিন পূর্বপরিচিত পুুলিশ কর্মকর্তা তৌহিদ সাহেবের বাড়িতে রাতে থাকেন। সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে গিয়ে ওয়াহিদ বলেন, ‘ছয় দিন ভাত খাইনি। তৌহিদ সাহেবের বাড়িতে হাত-মুখ ধুয়ে মুখে ভাত তুললাম। ভাতের সঙ্গে প্রায় আধা সের গোশতও খেয়েছি।’

 

যশোর ও ঝিনাইদহের পর চুয়াডাঙ্গা

ওয়াহিদ সরদার ২৬ আগস্ট রওনা হন চুয়াডাঙ্গার দিকে। ২৭ আগস্ট বৃষ্টি ছিল খুব। তখন ডাকবাংলো বাজার থেকে ১০০ টাকা দিয়ে একটি মাথাল কেনেন। সেটিকে রং করেন বাংলার পতাকার লাল-সবুজ রঙে। সাঁথিয়ার মোড় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে চা খেয়ে বিকালে পৌঁছান হরিণাকুন্ডু উপজেলা পরিষদের গেটে। তারপর ২৮ ও ২৯ আগস্ট চুয়াডাঙ্গা শহরের গাছগুলো থেকে পেরেক তোলেন। ৩১ তারিখ রওনা দেন যশোরের পথে।

 

পেরেক জমা করেন

একটা বড় বস্তা আছে ওয়াহিদের। তাতে পেরেকগুলো জমা করেন। গত দুই মাসে ৮১ কেজি পেরেক তুলেছেন। পেরেকগুলো দেড় থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা। ওয়াহিদ বলেন, ‘বাড়ি ছাড়া হওয়ার কারণে অনেক কাজ জমেছে। সেগুলো সেরে আবার পথে নামবেন। চালিয়ে যাবেন গাছ রক্ষার যুদ্ধ।’

 

ওয়াহিদের সংসার জীবন

ওয়াহিদ সরদারের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী। ছোট ছেলে পড়াশোনা করে। মেয়ে নাছিমা রহমানের বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে। সরদারের স্ত্রী মঞ্জুয়ারা বিবি একটু কষ্ট নিয়েই বলেন, ‘আমরা সব সময় তাকে কাছে পাই না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান তিনি। তবে ভালো কাজ করেন বলে নিষেধও করতে পারি না।’ সরদারের বড় ছেলের স্ত্রী যশোর সরকারি এম এম কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী রাবেয়া খাতুন। শ্বশুরে মহৎ কাজকে স্বাগত জানিয়ে রাবেয়া বলেন, ‘বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছি। এখানে শ্বশুর বাবার মতো। নিয়মিত তার দেখা পাই না। আদর পাই না। তার জন্য মনে কষ্ট আছে। তবে তিনি পরিবেশ বাঁচাতে, গাছ বাঁচাতে কাজ করছেন, এতে আমি গর্ববোধ করি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর