শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
মাত্র ১০ মিনিটেই সম্ভব শনাক্তকরণ

ক্যান্সার শনাক্তে বাংলাদেশি উদ্ভাবকের সাফল্য

সাইফ ইমন

ক্যান্সার শনাক্তে বাংলাদেশি উদ্ভাবকের সাফল্য

মানুষ বছরের পর বছর মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। অনেক মেধাবীর হাত ধরেই এই ভয়াবহ ব্যাধি নির্ণয় ও নিরাময়ে এসেছে সাফল্য। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি ড. সিনা।

 

ক্যান্সার এক ভয়াবহ ব্যাধি। মানুষ বছরের পর বছর এই মরণব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা চলছে। মেধাবী গবেষকদের হাত ধরে আসছে সাফল্য। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আরও একটি নাম যুক্ত হলো। তিনি বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. আবু আলি ইবনে সিনা। তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে এবার ক্যান্সার শনাক্ত হবে মাত্র ১০ মিনিটে। যুগান্তকারী এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. আবু আলি ইবনে সিনা। তিনি বলেন, নতুন উদ্ভাবিত এই টেস্টটির মাধ্যমে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে। আর তাই চিকিৎসাও শুরু করা যাবে দ্রুত! আর তার গবেষণার বিশেষত্বও এখানেই। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হলে বেঁচে যাবে লাখো প্রাণ। তাও এই ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাবে খুবই কম সময়ে, সহজ এবং সাশ্রয়ী পরীক্ষার মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা বলছেন মাত্র ১০ মিনিটে সব ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে উদ্ভাবিত নতুন এই প্রযুক্তিতে। যুগান্তকারী এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. আবু আলি ইবনে সিনা। সফল এই গবেষণায় তার সঙ্গে নেতৃত্বে ছিলেন অস্ট্র্র্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ড. লরা কারাসকোসা এবং অধ্যাপক ম্যাট ট্রাউ। ক্যান্সার শনাক্তে নতুন এবং কার্যকর এ পদ্ধতি উদ্ভাবকরা অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক। আবিষ্কারটি বিশ্বে সাড়া ফেলার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং সহজ ব্যবহার পদ্ধতি। বর্তমানে একেক ক্যান্সার নির্ণয়ে একেক রকম টেস্ট করতে হয়। আর বেশির ভাগ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আগে বোঝা যাবে, এমন কোনো টেস্ট নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রে রোগীর ক্যান্সার ধরা পড়ে এমন পর্যায়ে, যখন তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু নতুন উদ্ভাবিত এ টেস্টটির মাধ্যমে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে। এতে করে ক্যান্সারের হাত থেকে লাখো মানুষকে বাঁচানো যাবে। সম্প্রতি তাদের ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণা বিখ্যাত নেচার সাময়িকীর নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত এর পরপরই তাদের এ গবেষণার খবর নজরে আসে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত সব পত্রিকায় যেমন- সিএনএন, ফোর্বস, নিউইয়র্ক পোস্ট, ইউএসএ টুডে, গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। ভবন, সামনে অনেক সাধারণ গাইড দাঁড়িয়ে আছে, নানা রকমভাবে বুঝাচ্ছেন, তারা সব ব্যবস্থা করবেন, তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। ইমপিরিয়াল ভবনের গেটে কর্মরত ছিল একজন বাঙালি, আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন, আমরা বাংলাদেশি জেনে ভালো পরামর্শ দিলেন, বাইরের গাইডের সঙ্গে না যেতে। বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কী করতে হবে।

টিকিট কাটতে তেমন একটা ভিড় ছিল না। উপরে লিফট থেকে বের হতে সামনে অনেক দর্শক দুই তিন লাইন ধরে ছাদে উঠছে, আমরাও উপরে উঠলাম, সন্ধ্যার একটু আগে, একটু পরে সূর্য ডুবছে ডুববে, এ রকম শীর্ষ ভবন থেকে শহর দেখার অদ্ভুত মজা। একটু একটু করে সূর্য ডুবছে, ভবনগুলো থেকে একটু একটু করে আলো উঁকি মারছে। সেই সঙ্গে মনের ভিতর একটু একটু করে শিহরণ জাগছে ।

এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলাম। সূর্য ডোবার আগে চারদিকে ঘুরে একবার ছবি তুলেছি, যত অন্ধকার হচ্ছে নিউইয়র্ক শহর স্বপ্নের বাগানে পরিণত হচ্ছে। রিভার ক্রুজে গিয়ে নিউইয়র্ক সিটির বড় বড় অট্টালিকা থেকে আলোর প্রতিফলন নদীতে ভাসতে দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আকাশ থেকে নিউইয়র্ক শহর দেখতে এত আকর্ষণীয় চিন্তা করতে পারিনি। আমি চারদিকে ঘুরছি আর ছবি তুলছি।

ছবি তুলতে তুলতে এক সময় মনে হচ্ছিল ঠাণ্ডায় হাত কাঁপছে। বুকের মধ্যে ক্যামেরাটা চেপে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে রইলাম।

চাঁদপুরের বাবুরহাটের ছেলে বিজ্ঞানী ড. আবু আলি ইবনে সিনা। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর কিছুদিন বার্জার পেইন্টসে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন বায়োকেমিস্ট্রি এবং মলিকুলার বায়োলজি বিভাগে। এরপর উচ্চতর গবেষণা ও পিএইচডি করতে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে ন্যানো টেকনোলোজি থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে রিসার্চ ফেলো হিসেবে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছেন। এই বিজ্ঞানীর বাবা মো. শহীদুল্লাহ এবং মা সুরাইয়া আক্তার দুজনই শিক্ষক ছিলেন। বাবা-মা দ্বারাই অনুপ্রাণিত এই বিজ্ঞানী সারা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চান। বর্তমানে স্ত্রী সাবিহা সুলতানা ও ছেলে জাবির ইবনে হাইয়ানকে নিয়ে অস্ট্র্রেলিয়ায় বসবাস করছেন তিনি।

গবেষণা শুরুর অবস্থা প্রসঙ্গে ড. আবু সিনা বলেন, ‘২০১৬ সালে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করি। টিমে আমি এবং বাকি দুজন অস্ট্রেলিয়ান গবেষক। আমরা তিনজন প্রধান উদ্ভাবক। আমি বাংলাদেশি আবু সিনা, অস্ট্রেলিয়ার ড. লরা কারেস্কোসা ও প্রফেসর ম্যাট্রাউ। আমরা যখন প্যাটেন্ট করেছি এই তিনজন সমানভাবে অংশীদার।’

গবেষণাকর্মটি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন বিজ্ঞানী ড. আবু আলি ইবনে সিনা। তাদের উদ্ভাবিত ক্যান্সার শনাক্তে নতুন ও কার্যকর এ পদ্ধতিকে তারা বলছেন ‘ইউনিভার্সেল ক্যান্সার বায়োমার্কার’। তারা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ডিএনএর এমন একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পেরেছেন, যা সব ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান। এ জন্য তাদের উদ্ভাবিত ক্যান্সার শনাক্তের পদ্ধতিকে ‘ইউনিভার্সেল বায়োমার্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিজ্ঞানী ড. আবু আলি ইবনে সিনা বলেন, ‘ইউনিভার্সেল ক্যান্সার বায়োমার্কারের মাধ্যমে মাত্র ১০ মিনিটে ক্যান্সার শনাক্তের প্রযুক্তিটি আমরা ২০১৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেছি। তিন বছর গবেষণার পর নেচার সাময়িকীতে প্রবন্ধ দেই। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।’

ড. সিনা আরও বলেন, ‘তাদের গবেষণার বিশেষত্ব হচ্ছে- এর আগে এভাবে সব ধরনের ক্যান্সার শনাক্তে একই বৈশিষ্ট্যের ডিএনএ সম্পর্কে কারও ধারণা ছিল না। মূলত এখনো ক্যান্সার একটি জটিল রোগ, যা শরীরের যে কোনো অংশে (অঙ্গ) শুরু হতে পারে। একেক অঙ্গের ক্যান্সার একেক রকম। এ জন্য বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন ক্যান্সারের ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা এতদিন এমন একটি ইউনিভার্সেল বায়োমার্কারের সন্ধান করছিলেন, যেটি সব ক্যান্সারের কমন (সাধারণ) বৈশিষ্ট্য বহন করবে এবং যেটি বডি ফুইড যেমন- রক্ত, মূত্র কিংবা মুখের লালাতে পাওয়া যাবে।’ এক্ষেত্রে নিজেদের উদ্ভাবিত পরীক্ষা-পদ্ধতি সম্পর্কে ড. আবু সিনা বলেন, ‘প্রথমে আপনি ব্লাড থেকে ডিএনএটা বের করে নেবেন। এরপর ডিএনএ খালি চোখে দেখার ক্ষেত্রে গোল্ড ম্যানে পার্টিকেলের সঙ্গে আপনি যখন ডিএনএ মিক্সড করবেন তখন এর সঙ্গে অল্প একটু লবণ যোগ করলে যদি ক্যান্সার হয় মেনোপার্টিকেলের গোলাপি রং সেটা পরিবর্তন হবে না। যদি ক্যান্সার না হয় তাহলে রং পরিবর্তন হয়ে সেটা নীল হয়ে যাবে।’ আর এভাবেই শনাক্ত করা যাবে যে কোনো ধরনের ক্যান্সার। আর প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে ম্যাক্সিমাম ১০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এর আগে ক্লিনিক্যাল প্রসিডিউর যা সাধারণত একটি ক্লিনিকে আপনি যাবেন সেখানে গিয়ে ব্লাড স্যাম্পলটা কেউ একজন কালেক্ট করবে। এরপর সেখান থেকে যে ডিএনএ বের করবে সেটা করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগতে পারে। ডিএনএ বের করার পর এটা ডিটেকশন করতে এই ১০ মিনিট সময়টুকু লাগবে। বিশ্বজুড়ে এমনই অনেক বাংলাদেশি নিজ নিজ সাফল্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য অবস্থানে।

সর্বশেষ খবর