শনিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
অনুপ্রেরণীয়

যৌনদাসী থেকে নোবেলজয়ী

ইরাকি মানবাধিকারকর্মী নাদিয়া মুরাদের বিস্ময় জীবন

সাইফ ইমন

যৌনদাসী থেকে নোবেলজয়ী

অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে নাদিয়ার জীবন বাঁচানো ওমর আবদুল জব্বারের কাহিনী। মসুল ছেড়ে আইএসের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাদিয়াকে নিয়ে পালিয়েছিলেন তিনি

 

বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী নারী নাদিয়া মুরাদের নাম এখন সবারই জানা। নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করেছেন ইরাকের এই ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী। বাস্তবতার কঠিন নির্যাতনের জাল থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এ পুরস্কারটি অর্জন করলেন তিনি, তা নিয়ে অবাক পুরো বিশ্ব। শুধু এখানেই শেষ নয়। বরং প্রথম ইরাকি হিসেবেও এই অর্জন অনন্য হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। নাদিয়ার পথটি মোটেও সহজ ছিল না। তার বয়স মাত্র ২৫। এরই মধ্যে তিনি দেখে ফেলেছেন জীবনের নৃশংস রূপ। জঙ্গিদের যৌনদাসী হয়ে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন।

শাস্তি-স্বরূপ গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে তাকে। প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে বারবার পালানোর চেষ্টা করে অবশেষে পালাতে সফল হন নাদিয়া মুরাদ। তারপর দাঁড়িয়েছেন তার মতো হাজারো নির্যাতিতা নারীদের পাশে। অনুপ্রেরণীয় একজন হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নাদিয়া মুরাদ, পেয়েছেন বিশ্ববাসীর ভালোবাসা আর সম্মান, যার সর্বশেষ প্রাপ্তি গত বছর যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল জয়। পাকিস্তানের নারী শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফ জাইয়ের পর সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক এই পুরস্কার জিতলেন ইয়াজিদি এই তরুণী।

ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ছোট্ট গ্রাম কোচোতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন নাদিয়া মুরাদ। দারিদ্র্যের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট জিহাদি জঙ্গিরা ২০১৪ সালে যখন সিরিয়া এবং ইরাকে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে তখন থেকেই তার দুঃস্বপ্নের শুরু। ওই বছরের আগস্টের এক দুঃস্বপ্নময় দিনে আইএস জিহাদিদের কালো পতাকা বহনকারী একটি গাড়ি নাদিয়ার গ্রামে প্রবেশ করে। এরপর আইএস জঙ্গিরা পুরুষদের হত্যা করে, শিশুদের

জঙ্গি বানানোর উদ্দেশ্যে বন্দী করে এবং নারীদের জোরপূর্বক যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। আইএসের একটি পক্ষ অপর একটি পক্ষের কাছে যৌনদাসী হিসেবে মুরাদকে বিক্রি করে দেয়। এরপর সিরিয়ান, ইরাকি, তিউনিসিয়ান ও ইউরোপিয়ান আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় তাকে। কঠিন যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে এই নারীকে। অজানা আশঙ্কায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত।

এভাবে তিন মাস অতিক্রম করার পর অনেক কৌশল করে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। তবে পালিয়ে এসেই থেমে যাননি। বরং যোগ দেন আইএসের হাতে বন্দী ইয়াজিদি নারীদের মুক্তির সংগ্রামে। রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে । পরিণত হন ইয়াাজিদিদের মুক্তির প্রতীকে। যৌন নিপীড়িত-নির্যাতিত এই নাদিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শরণার্থীদের আইনজীবী হিসেবে।

এক সাক্ষাৎকারে নিজেই এই লোমহর্ষক কাহিনী শুনিয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ শিরোনামে নাদিয়ার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আইএসের কাছ থেকে পালিয়ে আসার পর নাদিয়া মুরাদ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন। মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী আমাল কুনির সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী ইয়াজিদি নারী ও যাঁরা পালিয়ে এসেছেন, তাদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের সবাই গরিব। কিন্তু এতেই সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন, সুখী ছিলেন।

২০১৪ সালে আমাদের গ্রামে ঢোকে আইএস। তারা অন্য পুরুষদের সঙ্গে আমার ছয় ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। পরে আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী নারীদের সঙ্গে আমাকেও বাসে মসুল শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসে যাওয়ার সময় আইএসের জঙ্গিরা নারীদের শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানি করে।’  নোবেলজয়ী এই তরুণী বলেন, ‘বাস থেকে নামিয়ে যৌনদাসী হিসেবে আমাদের বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এক ব্যক্তি দেখেশুনে তিনজন নারীকে পছন্দ করে। পরে মার্কিন ডলার দিয়ে তাদের কিনে নিয়ে যায়। আরেক ব্যক্তি আমার পেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। এর অর্থ কিনতে চায় সেই ব্যক্তি।’ পরে ওই ব্যক্তি নাদিয়াকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। নাদিয়া বলেন, ‘সব সময় এই বেদনাদায়ক গল্প বলতে আমার ভালো লাগে না। এ কারণেই এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমি বইয়ে লিখেছি।’ তিনি আরও বলেন, আইএস জঙ্গিরা ইয়াজিদি নারী, তরুণী এমনকি নয় বছর বয়সী কন্যাশিশুকেও যৌন নির্যাতন করতে ছাড়ে না। তাদের অপহরণের শিকার অনেক ইয়াজিদি নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।’ যৌনদাসী হিসেবে থাকার পর একদিন পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে যান নাদিয়া। শাস্তি হিসেবে তিনি গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। নাদিয়া বলেন, ‘পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েও আমি ভেঙে পড়িনি। কারণ হাজারো নারী আইএসের হাতে বন্দী আছেন। এ ভাবনাই আমাকে সাহস দিয়েছিল।’ অন্ধকারকে ছুড়ে ফেলে সাহসী পদক্ষেপে আলোতে সাহসী নাদিয়া সবার জন্য অনুপ্রেরণীয় এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন পৃথিবীর সব শোষিত মানুষের জন্য। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর