শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘোড়দৌড়ের রানী তাসমিনা

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

ঘোড়দৌড়ের রানী তাসমিনা
যেখানেই ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হয় তাসমিনা বাবার সঙ্গে সেখানেই যায়। অন্যের ঘোড়া জিতিয়ে দেয় পুরস্কার যা পায় ঘোড়ার মালিককে দিয়ে দিতে হয়। হৃদয়বান কোনো মালিক তাদের যাতায়াত ভাড়াটা  দেন। তবু মেয়ের শখের কারণে বাবা চুপ থাকতে পারেন না। কোথাও প্রতিযোগিতার কথা শুনলেই মেয়েকে নিয়ে  ছোটেন...

 

বগুড়ায় ঘোড়া দৌড়ের প্রথম দিনে সবাইকে পেছনে ফেলে ছুটে আসল তাসমিনা। ঘোড়া থেকে নামতেই চারদিকে ভিড় জমে গেল। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে বলে নই- তাসমিনাকে এক নজর দেখার জন্যই এই ভিড়। ঘোড়দৌড়ের রানী তকমাটা যার গায়ে জড়ানো সেই তাসমিনার বয়স মাত্র চৌদ্দ। প্রথম কথাতেই বলল, ঘোড়া দৌড়াতেই আমার ভালো লাগে। এই যে মানুষজন তার ঘোড়দৌড় দেখতে ছুটে আসেন এটাতেই তার আনন্দ। পুরস্কার জেতার নেশার চেয়ে ঘোড়ায় চড়ে উড়ে যাওয়া তাসমিনার গল্পটা শুরু খুব কম বয়সে। তাসমিনা নিজেই সে গল্পটা জানাল। বলল, আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। বাসায় একটা ঘোড়া ছিল। ওই ঘোড়ার সঙ্গে মাঠে-ঘাটে যেতাম। ঘোড়ার সঙ্গে খেলতাম। ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছাটাই তখন জাগে।’ ঘোড়ায় চড়ার প্রথম স্মৃতি তাসমিনা ভুলে যায়নি। সে বলল, ‘আমি যখন ঘোড়ায় চড়ে মাঠে দৌড়াতাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। জোরে ঘোড়া দৌড়াতে দেখে সবাই অবাক হতো।’ সেই ঘোড়াটি অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দেন তাসমিনার বাবা। মন ভাঙে তার। স্থানীয় লোকজন তাসমিনার বাবাকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে বাকিতে ঘোড়া কিনে দেয়। তার মেয়ের ইচ্ছা আর ঘোড়া ছোটানোর দক্ষতা ততদিনে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। তাই বলে আট বছরের মেয়ে আর ঘোড়দৌড়ে কতটা ভালো করবে? সেই প্রশ্নের জবাব তাসমিনা ভালো মতোই দিল। জীবনে প্রথমবার কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হলো। প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়াটা তার নেশা নয়। তার নেশা ঘোড়ার সঙ্গে হাওয়ার ঝাপটা লাগানোয়। ঘোড়া ছুটলেই তার আনন্দ লাগে। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়ার শখ ছিল তার।

তাসমিনার সঙ্গে কথা হলো বগুড়ায়।  ফোন পেয়ে ছুটে আসা তাসমিনা বলল, আমার মন খারাপ। অবাকই লাগে শুনে। প্রথম হয়েও মন খারাপ কেন? তাসমিনা বলল, ‘এইটা তো আমার ঘোড়া না।’ ঘোড়া দৌড়ের পুরস্কারটা যায় যার ঘোড়া তার হাতে। অন্য মালিকের ঘোড়া ছুটিয়েই কিন্তু দেশ-বিদেশে মানুষের মন ছুঁয়েছে তাসমিনা। এখানেও হাজার হাজার মানুষ ঘোড়দৌড় দেখতে ছুটে এসেছেন। সবার চোখ ছিল তাসমিনার দিকে। অতটুকুন মেয়েকে ঘোড়ায় ছুটতে দেখাও তো বড় চমক। সেই চমকের শেষ হলো বিস্ময় দিয়ে। সবাই অবাক হয়ে দেখল, তাসমিনা রেসে অংশ নিয়েই প্রথম হলো। তাসমিনার আট বছরের গল্প রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার বাবার কাছে ঘোড়দৌড়ের খবর আসলেই তাসমিনা ছুটে যায়। নিজের ঘোড়া না থাকায় অন্য মালিকের ঘোড়া নিয়েই নেমে পড়ে দৌড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সমগ্র দেশে। তারকা খ্যাতি জুটিয়ে নাম হয়েছে ‘দ্যা হর্স গার্ল’ হিসেবে।

তাসমিনা বলে, ‘আমার ঘোড়া ছোটাতেই ভালো লাগে। ১ মাস আগে একটা ঘোড়া পেয়েছি। আমি আর আমার মা দুজনে মিলে ঘোড়ার যত্ন নেই।’

ঘোড়দৌড়ে সবার নজর কাড়লেও তাসমিনা চায় পড়াশোনা করে পুলিশে চাকরি করতে। পুলিশের পোশাক তার কৌতূহল জাগায়। তাসমিনা এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

তাসমিনার বাবা ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘কোথাও প্রতিযোগিতার কথা শুনলেই মেয়েকে নিয়ে  ছোটেন। ঘরটুকু ছাড়া কোনো জমি  নেই।’ দিনমজুরই তার একমাত্র  পেশা। অভাব-অনটন জেঁকে বসেছিল সংসারে। তাসমিনার কল্যাণে সংসারের চাকা একটু সচল হয়েছে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে সম্মানি ও যাতায়াত ভাতা ছাড়াও মিলছে নানা পুরস্কার।

তাসমিনার পরিবার শুরুর দিকে ঘোড়দৌড়ে সায় না দিলেও একসময় ঠিকই মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। তাসমিনা বলল, শুরুর দিকে তাকে ঘোড়ার পিঠে দেখে অনেকেই অবাক হতো। এখন আর তেমন হয় না। বাবা-মা থেকে শুরু করে সবাই তাকে সাহায্য করেন। তাসমিনা বলল, এখন সবাই আমার ঘোড়দৌড় দেখে প্রশংসা করেন। আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার ঘোড়দৌড়ে খুশি।’ ঘোড়দৌড়ে সে একের পর এক সেরার পুরস্কার। ঘোড়সওয়ারি তাসমিনাকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র অর্শ্বারোহী তাসমিনা অলিম্পিয়া ফিল্ম  ফেস্টিভ্যাল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং পিপলসে স্থান পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে প্রামাণ্যচিত্রটি। রোমানিয়ায় ট্রান্সসিলভানিয়া শর্টস ফিল্ম  ফেস্টিভ্যাল, বার্লিনে কন্ট্রাভিশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যুক্তরাষ্ট্রের এলএসিনে ফেস্ট এ অফিশিয়াল সিলেকশন ও অনারেবল মেনশন পুরস্কার জিতেছে।

প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব জায়গায় মেয়ে প্রথম হয়। ঘোড়া জিতিয়ে টেলিভিশন, কম্পিউটারসহ অনেক পুরস্কার  পেয়েছে তাসমিনা কিন্তু বাড়ি  ফেরার সময় খালি হাতে ফিরতে হয়। তাসমিনা এখন ব্যস্ত পড়াশোনা আর ঘোড়দৌড়ে। তার চাওয়া একটা ভালো ঘোড়া। রেসের ঘোড়া কেনার মতো টাকা তার নেই। তাসমিনা বলল, ‘পড়াশোনা শেষ করে আমি পুলিশ হতে চাই। পাশাপাশি ঘোড়দৌড়েও থাকব। দেশের যে জায়গাতেই সুযোগ পাই আমি দৌড়ে অংশ নেব। আমার ইচ্ছা আছে, বিদেশেও এমন ঘোড়দৌড়ের সুযোগ পেলে অংশ নেওয়ার।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর