শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ যখন রাজপথের শৃঙ্খলায়

জয়শ্রী ভাদুড়ী

চ্যালেঞ্জ যখন রাজপথের শৃঙ্খলায়

ছবি : জয়ীতা রায়

ঋতুতে এখন শীতকাল। কিন্তু মধ্য দুপুরে রাজধানীর তাপমাত্রায় এখনই গ্রীষ্মের উত্তাপ। যানবাহনের চাকায় পৃষ্ট হয়ে ছুটে আসা ঘূর্ণিকায় ধুলায় চোখ তুলে তাকানো দায়। এর মধ্যে রামপুরা ব্রিজে দাঁড়িয়ে যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে দেখা যায় একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে। যানবাহনের মামলা সংক্রান্ত বিষয় দেখভালের পাশাপাশি পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে দেখা যায় তাকে। তার পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানলাম তিনি রামপুরা ট্রাফিক জোনের (ট্রাফিক পূর্ব বিভাগ) সহকারী পুলিশ কমিশনার (সম্প্রতি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) মোছা. লুবনা মোস্তফা। নগরবাসীর পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজপথে আইনের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে বাড়ছে নারীদের অংশগ্রহণ।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন নারীদের সরব অংশগ্রহণ। পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। এরপর সার্জেন্ট পদে নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ৮৩৭ জন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৪৬ জন। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ পান ২৮ জন। সেই ধারাবাহিকতায় ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। জনবহুল ঢাকার ক্রমবর্ধমান যানজট থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন তারা। এই পর্যন্ত আসার সময়ে তাদের পার হতে হয়েছে বন্ধুর পথ।

গল্পটা শোনালেন যমুনা পাড়ের মেয়ে লুবনা মোস্তফা নিজেই। স্মৃতির পাতা হাতড়ে শৈশবে ফিরে যান তিনি। বলেন, আমার জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরে। সদর উপজেলাতেই আমাদের বাড়ি। আমার শৈশব-কৈশর পড়াশোনা সেখানেই। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হই বাড়ির কাছে ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকায় বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হই। এরপরেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। অনার্সে ভর্তি হই ইডেন মহিলা কলেজে। তখন থেকেই চিন্তাভাবনা ছিল জীবনে ভালো কিছু করব। কিন্তু পুলিশের চাকরিতে আসব এরকম কিছু ভাবিনি। তবে পুলিশের এই পোশাকটার প্রতি আগে থেকেই একটা আগ্রহ কাজ করত। মাস্টার্স শেষে বন্ধুবান্ধব মিলে বিসিএসে ফরম পূরণ করেছিলাম।

২৮তম বিসিএসে প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই শিক্ষা ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে পাস করি। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরে পুলিশ প্রশাসনে কাজের আগ্রহ তৈরি হয়। এই পোশাকটার প্রতি আগের আগ্রহ আরও প্রবল হয়। ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হই। এরপর ডিবিসহ পুলিশের বিভিন্ন শাখায় কাজ করে বর্তমানে ট্রাফিকের সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

এই পেশার চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়েদের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়। পুলিশে চ্যালেঞ্জটা খুব বেশি। আর ট্রাফিক পুলিশের প্রতিটি মিনিটেই চ্যালেঞ্জ। এখানে মানুষের সন্তুষ্টি আদায় করা খুব কঠিন।

গত মঙ্গলবার ফার্মগেটে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করতে দেখা যায় তিনজন নারী পুলিশকে। এক হাতে গাড়ি থামানো ইশারা দিয়েই অন্য হাতে গাড়ি চলাচলের ইঙ্গিত দিতে হচ্ছে তাদের। কাজের ফাঁকে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের নারী কনস্টেবল সন্ধ্যার সঙ্গে। কাজের চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে বলেন, চলন্ত রাস্তায় গাড়ি থামানো একটু চ্যালেঞ্জের। প্রথম দিকে অসুবিধা হতো। আমার অন্য সহকর্মীদের সহায়তায় কাজগুলো শিখে নিয়েছি। আগে যানজটে বসে ভাবতাম ট্রাফিক পুলিশ কী করে! এখন বুঝি ট্রাফিকের কাজ চোখে দেখে সহজ মনে হলেও অতো সহজ নয়। একদিকে গাড়ি থামার ইশারা দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন তিনি। ‘পথচারীদের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পার না হয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে উৎসাহিত করাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একটু বেখেয়াল হলেই তারা দৌড় দেয়।’ খামারবাড়ি মোড়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় শেফালী আক্তারকে। একজন বৃদ্ধ নারীকে জেব্রাক্রসিং পার হতে সাহায্য করছিলেন তিনি। কখনো কোনো খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রথম দিকে ড্রাইভার কিংবা পথচারীরা নারী ট্রাফিকদের নিয়ে ব্যঙ্গক্তি করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। আমাদের সহকর্মীদের কাছে নারী বলে কোনো ভিন্ন অভিব্যক্তি পাইনি। তবে নারী ট্রাফিকদের রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করলেও প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহারের কোনো বন্দোবস্ত নেই। পাবলিক টয়লেট কিংবা শপিংমলের ওয়াসরুমে যেতে হয়। এ বিষয়গুলো একটু নজরে আনলে নারীদের কাজ আরও সহজ হবে।’

এরকম চ্যালেঞ্জের গল্প শোনালেন রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (সম্প্রতি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) কাজী রোমানা নাসরিন। ১১ মাস ধরে তিনি ট্রাফিক পুলিশে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০১৩ সালে আমি বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি।

গোলাপগঞ্জে চাকরি করেছি কিছুদিন এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর কিছুদিন লালবাগ ক্রাইম জোনে দায়িত্ব পালন শেষে এখন এখানে ট্রাফিক বিভাগে কাজ করছি। পাহাড় ঘেরা জনপদ খাগড়াছড়িতে বেড়ে ওঠা মেয়েটি এখন দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে। খাগড়াছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ থেকে কৃতিত্বে সঙ্গে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন তিনি।

পেশায় চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে বলেন, মেয়েদের স্বামী, সংসার, সন্তান সামলে কাজ করতে হয়। আমার ছেলেটির বয়স এখন ছয় বছর। তারপরেও পুরুষ কর্মকর্তাদের তুলনায় আমরা এতটুকু কম পরিশ্রম করি না। কিংবা নারী হিসেবে সহানুভূতি আদায়ের প্রয়োজন পড়ে না। যে যতটুকু আসছি নিজের যোগ্যতায়। ট্রাফিক পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ডে অফও হয় না। সকাল ৭টা থেকে ডিউটি শুরু হয়ে শেষ হয় রাত প্রায় ১১টায়। এ ছাড়া ট্রাফিক পক্ষ কিংবা সপ্তাহ পড়লে জুনিয়রের ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া যায় না। তখন অনেক সময় হিসাব করলে ২৪ ঘণ্টার ডিউটিও করা হয়। তবে কর্মজীবী নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করেছে। এখন আর রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দেখলে ড্রাইভারদের অভিব্যক্তি তেমন একটা বদলাতে দেখি না। একদিনে হয়তো সম্ভব না তবে নারীদের এই পেশায় অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক। আমাদের প্রতিদিনের পরিশ্রমের সফলতায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশের নারী।

সর্বশেষ খবর