শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

জীবন সংগ্রামে জয়ী অদম্য আয়েশা

এম আবু সিদ্দিক, চরফ্যাশন (ভোলা)

জীবন সংগ্রামে জয়ী অদম্য আয়েশা

বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় স্বামী ইব্রাহিম মিয়া চলে যান না ফেরার দেশে। আর অল্প বয়স্ক আয়েশা ইব্রাহিমের কাঁধে পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব। এক ছেলে ইকরাম ও এক মেয়ে জুলেখা ইয়ামুনকে নিয়ে অথৈ সমুদ্রে একলা নাবিক তিনি। শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয় না। আত্মসম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িতেও যেতে নারাজ আয়েশা ইব্রাহিম। স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বেয়ে সন্ধান করেন কূলের।

সেরা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে রোকেয়া দিবসে জয়িতা পুরস্কার গ্রহণ, ভোলা জেলার শ্রেষ্ঠ তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রাপ্তিই কেবল নয়, অসাধারণ জীবনের গল্প রচনা করেছেন যে নারী, তিনি চরফ্যাশনের আয়েশা ইব্রাহিম।

চরফ্যাশন শহরের প্রাণকেন্দ্র ইব্রাহিম প্লাজায় ‘আয়েশা ওড়না হাউস’ নামে তার ওড়না হাউসটি প্রতিবারের মতো এবারও সরগরম ছিল ঈদ মৌসুমে। আয়েশা ইব্রাহিমের আজকের অবস্থানে আসার গল্পটা রীতিমতো এভারেস্ট জয়ের মতো। অল্প বয়সে এক দিন স্কুল থেকে এসে নিজের বিয়ের কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন কিশোরী আয়েশা ওরফে চম্পা। কোনো কিছু বলার বা মতামত দেওয়ার ফুরসতটুকুও সেদিন দেওয়া হয়নি তাকে।

যে বয়সে এ-গ্রাম ও-গ্রাম বেণি দুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা, আর এ বয়সে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। অপ্রত্যাশিতভাবেই বউ সেজে যেতে হয় শ্বশুরবাড়িতে। গল্পটি চরফ্যাশন উপজেলার আসলামপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান আয়েশার।

বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ২০০৫ সালের ১৯ এপ্রিল স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। আয়েশার ওপর পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অথৈ সমুদ্রে একলা নাবিক তিনি। শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয় না। আত্মসম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িও যেতে নারাজ আয়েশা। স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বেয়ে সন্ধান করেন কূলের।

এক সময় পরিকল্পনা করেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে।  যেই ভাবনা সেই কাজ। আত্মপ্রত্যয়ী আয়েশা শুরু করেন স্বপ্নের ফুল ফোটাতে। সে জন্য তিনি চরফ্যাশন বাজারের ইব্রাহিম প্লাজার দোতলায় প্রতিষ্ঠা করেন আয়েশা ওড়না হাউস। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আয়েশা প্রথমে তার বোন শাহনাজের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ও সাবেক ইব্রাহিম গার্মেন্টের স্টাফ রহমানের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা ধার নেন, আর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন তারই এলাকার ৫ জন অসহায় নারী পুরুষকে নিয়ে। পুঁজি আর জনবল নিয়ে ২০১১ সালের ১৩ জুন শুরু করেন ‘আয়েশা ওড়না হাউস’ নামে ক্ষুদ্র একটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। আর এখন বোরকা, ওড়না, হিজাব, স্কার্ফ, থান-কাপড়, থ্রি-পিসসহ মহিলাদের যাবতীয় তৈরি পোশাক বিক্রি করছেন আয়েশা। তবে গল্পটি যত সহজে লেখা গেল বাস্তবতা অতটা মসৃণ ছিল না আয়েশার জন্য। চোখ মুছে আয়েশা বলেন, ‘নারী হিসেবে ব্যবসা করার বিষয়টি সমাজ খুব সহজভাবে মেনে নেয় না। তাও আবার গ্রামের মতো জায়গা। পরিবার থেকেও সে সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। স্বামী মারা যাওয়ার সময় তেমন কোনো অর্থ রেখে যাননি। তাই অর্থই সে সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’

তবে সেলাই প্রশিক্ষণ অনেকটাই সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে তার জীবনে। পার্শ্ববর্তী মহিলাদের পোশাক বানানোর মধ্য দিয়ে শুরু করেন। সে সময় দৃঢ় মনোবল ও সাহসই ছিল তার বড় সঙ্গী।

আয়েশা ইব্রাহিমের বর্তমান অবস্থা জানতে চাওয়া হলে শোনা গেল তৃপ্ত কণ্ঠ। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমার এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ৫ জন নারী-পুরুষ। পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন শোরুমে পাইকারি হিসেবে পণ্য সরবরাহ করি। এ ছাড়া আমার দোকানের পণ্যের এখন চাহিদা অনেক বেশি। কারণ আমার দোকানের পণ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এ ব্যবসাকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।’

বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থ ও দিক নির্দেশনার অভাবÑ এমনটাই মনে করেন আয়েশা ইব্রাহিম। তিনি জানান, আসলে ব্যবসায় নামতে হলে কোন মাধ্যম থেকে পুঁজির ব্যবস্থা করা যাবে, সেটাই জানেন না অনেক নারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিলে টানতে হয় চড়া সুদ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সেবার তথ্য ভালোভাবে পৌঁছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন আয়েশা। তিনি উল্লেখ করেন, শুধু অর্থের জোগান হলেই হবে না, পণ্যের সঠিক বাজারজাতের পদ্ধতিও জানতে হবে।

নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি আয়েশার ঝুলিতে রয়েছে বেশ কিছু স্বীকৃতিও। ২০১৬ সালে তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জয়িতা পুরস্কার গ্রহণ করেন। তৃণমূল সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উপজেলা ও জেলা জয়িতা পুরস্কারও পেয়েছেন নিজের অগ্রণীয় ভূমিকার জন্য। তার ব্যাপারে নারী নেত্রী নীলিমা নিগার সুলতানা জ্যাকব, চরফ্যাশন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আকলিমা মিলা ও ট্যাপনাল ব্রেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক তাছলিমা হোসাইনদের মতো বিশিষ্টজনের ভাষ্যমতে, আয়েশা ইব্রাহিম এখন নারীর সংগ্রাম জয়ের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

আয়েশা ইব্রাহিম শুধু নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত নন, স্বপ্ন দেখেন অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। বাকি জীবনটাও সংগ্রাম করে কাটিয়ে দেব অসহায়দের পাশে থেকে।’

সর্বশেষ খবর