শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ

মানুষের পক্ষে লড়েন যে আইনজীবী

আরাফাত মুন্না

মানুষের পক্ষে লড়েন যে আইনজীবী

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

খাদ্য নিরাপত্তা, নদী-খাল উদ্ধার, পরিবেশ রক্ষা, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ জনস্বার্থে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ক মামলার আইনজীবী হিসেবে জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এ পর্যন্ত তিনি জনস্বার্থে মামলা করেছেন ২৯০টিরও বেশি।

 

সাধারণ মানুষের পক্ষে আইনি লড়াই করেন মনজিল মোরসেদ।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আদালতে তুলে ধরে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সব মহলে। খাদ্য নিরাপত্তা, নদী-খাল উদ্ধার, পরিবেশ রক্ষা, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান আদালতে। মানুষের জন্য তার এই আইনি লড়াই। শুধু পরিবেশ নিয়ে নয়, মানবাধিকার রক্ষায়ও তিনি আইনি লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই। লড়ছেন সাংবিধানিক সংকট ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়ও। অধিকার ফিরিয়ে দিতে পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষের। নদীকেও এনে দিয়েছেন মানুষের অধিকার। তার রিট আবেদনেই সম্প্রতি হাই কোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। দিয়েছে সাংবিধানিক অধিকার। দেশে প্রচলিত আইনকে কাজে লাগিয়ে বা আইনের আশ্রয় নিয়ে এরই মধ্যে মনজিল মোরসেদ জনস্বার্থ মামলার আইনজীবী হিসেবে জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। এ পর্যন্ত তিনি জনস্বার্থে মামলা করেছেন ২৯০টিরও বেশি। এসব মামলার মধ্যে এখনো পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি মামলায় চূড়ান্ত রায় পেয়েছেন। বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বৃহত্তর চার নদীরক্ষা, লালবাগ কেল্লাসহ ঐতিহ্যবাহী প্রতœতত্ত্ব স্থাপনা সংরক্ষণে আইনি লড়াই লড়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, পুলিশের হাতে নির্যাতনসহ নানা বিষয়ে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন উচ্চ আদালতের। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছেন মানুষের জন্য। মনজিল মোরসেদ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। এ সংগঠনটি ইতিমধ্যে লাখো মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। অন্যায়, অবিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হলেই এগিয়ে আসে অ্যাডভোকেট মনজিলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগঠনটি।

প্রথম যখন জনস্বার্থে মামলা করেছিলেন তখন সহকর্মী বা পরিবারের সদস্য, কেউ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। এমনকি আদালতও আবেদনগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করত না। কেউ কেউ অহেতুক সময় নষ্ট বলেও মন্তব্য করেছিলেন। তবে এখন সবাই জনস্বার্থে মামলা করতে উৎসাহিত করেন, আদালত থেকেও ভালো সারা পান, বলেন জানান মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, মানুষের জন্য কাজ করে যেমন স্বীকৃতি পেয়েছি, তেমনই হুমকি ধমকিও পেতে হয়েছে। অন্তত তিনবার হত্যার হুমকিও পেয়েছেন বলে জানান। একবার তো বাসায় কাফনের কাপরই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। মনজিল মোরসেদ বলেন, যখন স্বীকৃতি পাই, তখন পরিবার খুব খুশি হয়।

তিনি ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেছেন জাতীয় পরিবেশ পদক। জনগণের স্বার্থে মামলা করার ভাবনাটি এসেছিল প্রায় ২৮ বছর আগে, ১৯৯০ সালে। তখন জজকোর্টে প্র্যাকটিস করেন তিনি। হঠাৎ নিকটাত্মীয় মারা যাওয়ার খবর শোনেন। আজিমপুর কবরস্থানে দাফন হবে। জানাজায় অংশ নিতে রওয়ানা হলেও প্রায় তিন ঘণ্টা পর এসে পৌঁছালেন তিনি। কাজ শেষ করে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বের হওয়ার পরও জানাজা পেলেন না। তখন রাস্তার ওপরে গরুর হাট বসেছিল। তিনি চিন্তা করলেন সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী এসব জায়গায় হাট বসানো আইনে নেই। নানা প্রতিকূলতায় ওই সময় আদালতে যাওয়া হয়নি। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা থেকে ২০০৪ সালে সমমনা কয়েকজন তরুণ আইনজীবীকে নিয়ে গড়ে তোলেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। এই সংগঠনের পক্ষ থেকেই ২০০৬ সালে মনজিল মোরসেদ প্রথম জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেন রাজধানীর সড়কে গরুরহাট নিয়ে। আবেদনটি দেখেই বিচারক বললেন, আপনি জানেন এটা কী নিয়ে আসছেন? তখন দেশে তসলিমা নাসরিন ইস্যুতে আলেমরা খুব উত্তেজিত ছিল। ওই সময় আদালতের ভাব-ভঙ্গি দেখে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বছরখানেক পর একই আবেদন নিয়ে মনজিল মোরসেদ গেলেন হাই কোর্টের অন্য একটি বেঞ্চে। আদালত রুল জারি করলেন। পরে রুল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ে সড়কে গরুর হাট বসানো বন্ধে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। এই আদেশ বাস্তবায়নের পর এখন কোরবানির ঈদের সময়ও মানুষ স্বস্তিতে রাস্তায় চলাচল করতে পারে। ওই রায়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব হাটের বর্জ্য অপসারণ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। যা সিটি করপোরেশন এখন কার্যকর করছে।

মনজিল মোরসেদের সংগঠন এইচআরপিবির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বর্তমানে ২১ জন সদস্য আছেন। তিনি সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আদালতে মামলা লড়েন। অন্যরা সহযোগিতা করেন। ২৭টি বারে এইচআরপিবির শাখা কমিটি আছে। দেশের বাইরে কমিটি রয়েছে নিউইয়র্ক, বোস্টন, লন্ডন, বার্মিংহাম, লিভারপুল ও জেদ্দাসহ বিশে^র বিভিন্ন স্থানে। এইচআরপিবি নিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, একযুগেরও বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক অনুদান ব্যতীত আমরা কাজ করতে পেরেছি। সম্পূর্ণ নিজের টাকায় আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। আমরা অর্ধেক সময় জনস্বার্থে কাজ করি আর অর্ধেক সময় কাজ করি নিজের প্রয়োজনে। মনজিল মোরসেদের যুগান্তকারী রিট আবেদনগুলোর মধ্যে ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায় অবৈধ দখল বন্ধ করে বিচারক ও আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থী মানুষের যাতায়াত সহজ কর, বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করা, পাহাড়কাটা, জলাশয় ভরাট রোধ, সুচিত্রা সেনের বাড়ি উদ্ধার, বেগম রোকেয়ার বাড়ি থেকে গার্মেন্ট অপসারণ, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত অবৈধ দখলমুক্ত করা অন্যতম। সর্বশেষ দেশের ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা নিয়েও আদালতের দারস্থ হয়েছেন জনস্বার্থ মামলার এই আইনজীবী। তার আবেদনেই আদালত গত ২০ বছরের ঋণ খেলাপি ও অর্থপাচারকারীদের তালিকা চেয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। জনস্বার্থ মামলার আদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, কেউ সহজে আদেশ মানতে চায় না। এ জন্য লেগে থাকতে হয়। আমরা আমাদের আদেশগুলো বাস্তবায়নের জন্যও কাজ করি। কেউ আদেশ না মানলে প্রয়োজনে আদালত অবমাননার মামলা করি। এইচআরপিবির পক্ষে পাওয়া প্রায় সব আদেশই বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানান মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, এখন কাউকে কাউকে দেখি মামলা করেই আর তা মনিটরিং করে না। কেউ কেউ তো রুল শুনানিরও উদ্যোগ নেয় না। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনস্বার্থে কাজ করতে হলে, ওই কাজটা আসলেই জনস্বার্থে হতে হবে, নিজের স্বার্থে বা কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নয় বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।

মনজিল মোরসেদ ১৯৫৯ সালের ২২ জুন ঝালকাঠি জেলার সদর থানার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের বাউলকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা জবেদ আলী মিয়ার সন্তান। তার মায়ের নাম লাল ভানু।  পড়ালেখা করেছেন নিজ এলাকার প্রসন্নকুমার উচ্চবিদ্যালয়, বরিশাল কলেজ, ঝালকাঠি সরকারি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্ট্রাল ল’ কলেজে। ১৯৮৮ সালে আইন পেশা শুরু করেন। একই বছর হালিমা আক্তারকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই সন্তান। ছেলে অভিষেক মোরসেদ বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার রকস্টার ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি অধ্যয়নরত। মেয়ে অন্বেষা মোরসেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্রী। ১৯৯৯ থেকে পাঁচ বছর প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন ও অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ মামলায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে স্বাধীনভাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে পেশায় রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর