শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশাখা থেকে ‘যক্ষ্মা ম্যাডাম’

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

বিশাখা থেকে ‘যক্ষ্মা ম্যাডাম’

সকাল সাড়ে ৫টা। হঠাৎ বেজে উঠল মোবাইল ফোন। সাত সকালে আসা মোবাইলটি কাল বিলম্ব না করেই রিসিভ করেন ডা. বিশাখা ঘোষ। ফোনটি রিসিভ করার পরই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো অপরিচিত এক নারীর কণ্ঠস্বর। ফোন করা ওই নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, রাঙ্গামাটির দুর্গম উপজেলা লংগদু থেকে ফোন করছেন তিনি। তার ছেলে শফিউল আলম রিচার্জ কয়েকদিন আগে যক্ষ্মার চিকিৎসা নিয়ে গেছে চট্টগ্রাম যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে। কিন্তু ভোররাতে সে ফের অসুস্থ হয়ে গেছে। ওই নারীর সব কথা শুনে বিশাখা জানান, তার ছেলের এ অসুস্থতা যক্ষ্মার সঙ্গে সংশ্লষ্টি নয়। পরে ওই নারীকে কিছু পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ ডা. বিশাখা ঘোষ। শুধু রিচার্জের মা নন, এভাবেই প্রতিনিয়ত রাত-দুপুরে যক্ষ্মা রোগীদের নানা পরামর্শ ও সেবা দিতে ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছেন ডা. বিশাখা। যক্ষ্মা রোগীদের সেবা নিশ্চিত, পর্যবেক্ষণ, তদারকি করতে ছুটে বেড়াচ্ছেন নগর থেকে গ্রামে। তার পদচিহ্ন পড়েছে পাহাড়ি দুর্গম এলাকা লংগদু, দিঘীনালা,  নানিয়ারচর উপজেলা পর্যন্ত। বাদ যায়নি মহেশখালীর দুর্গম লবণ মাঠও। চট্টগ্রাম বিভাগ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে যে সাফল্য দেখিয়েছে তার অন্যতম সারথী হিসেবে মনে করা হয় এ বিশাখা ঘোষকে। গত এক দশক ধরে যক্ষ্মা রোগীদের পেছনে ছুটে চলা ডা. বিশাখা নিজের নাম ছাপিয়ে পরিচিত পেয়েছেন ‘যক্ষ্মা ম্যাডাম’ হিসেবে। রোগী থেকে শুরু করে তাদের আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের সহকর্মী কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আজ ডা. বিশাখার চেয়ে যক্ষ্মা ম্যাডামই বেশি জনপ্রিয় ও পরিচিত। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাসিমপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ডা. বিশাখা ঘোষের।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বিশাখা ঘোষকে ২০১৪ সাল থেকে কাছ থেকে দেখে আসছি। যেভাবে দুর্গম এলাকায় ঘুরে ঘুরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করেন তা অনেক পুরুষ করতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চট্টগ্রাম বিভাগে যে সাফল্য দেখিয়েছে তার অন্যতম কারিগর হচ্ছেন ডা. বিশাখা।’

যেভাবে যক্ষ্মা ম্যাডাম
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে যক্ষ্মা রোগীদের সেবায় যক্ষ্মাবিষয়ক চিকিৎসা, পর্যবেক্ষণ, তদারকি, মূল্যায়ন, পরিকল্পনা কর্মসূচিতে সমন্বয় করাই হচ্ছে ডা. বিশাখা ঘোষের মূল কাজ। কিন্তু তিনি মূল কাজের বাইরে গিয়ে ছুটে বেড়ান যক্ষ্মা রোগীদের দ্বারে দ্বারে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো রোগী কিংবা স্বজনদের কাছ থেকে শুনতে হয় কটু কথা কিংবা ভর্ৎসনা। কখনো বা পান উষ্ণ ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসা কিংবা ভর্ৎসনা কোনো কিছুই তিনি গায়ে নেন না। যক্ষ্মা রোগীদের সুস্থ জীবন দান ও যক্ষ্মা প্রতিরোধে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন নগর থেকে দুর্গম এলাকায়। গত এক দশকে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার ১০১ উপজেলায়। চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে বি-বাড়িয়া উপজেলার আশুগঞ্জ, চাঁদপুরের মতলব থেকে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা সব উপজেলায় নিয়মিত পদচিহ্ন রাখছেন তিনি। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তার গড়ে উঠেছে আলাদা ব্যক্তি ইমেজ। হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়। এ জনপ্রিয়তায় তাকে দিয়েছে আলাদা একটি পরিচিত। যা হচ্ছে ‘যক্ষ্মা ম্যাডাম’। রোগী কিংবা তাদের স্বজন সবাই তাকে এ নামেই সম্বোধন করেন। এমনকি সহকর্র্মীদের কাছেও তিনি ‘য² ম্যাডাম’ নামে পরিচিত। ‘য² ম্যাডাম’র ভিড়েই হারিয়ে যেতে বসেছে ডা. বিশাখা ঘোষ নামটি।
ডা বিশাখা ঘোষ বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক হলেও যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নই। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে একটি প্রকল্পে কাজ করি। আমার কাজই হচ্ছে যক্ষ্মা প্রতিরোধ কর্মসূচির পরিকল্পনা তৈরি করা, সেবাবিষয়ক চিকিৎসা, পর্যবেক্ষণ, তদারকি এবং মূল্যায়ন করা। কিন্তু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৃণমূলে ঘুরে বেড়িয়েছি। মূলত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যক্ষ্মা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জেনেছি। কাজ করতে গিয়েই এক কর্মসূচির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়েছি এখন জীবনের সব কিছুই যক্ষ্মা কেন্দ্রীয় হয়ে গেছে। এমনকি নিজের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন সবাই আমাকে যক্ষ্মা ম্যাডাম নামেই চেনে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক রোগী সুস্থ হয়ে ফোন করেন। তখন খুবই আনন্দ লাগে। অনেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তার বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করে। এ বিষয়গুলো খুবই ভালো লাগে। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বেশির ভাগ সময় দুর্গম এলাকার লোকজন চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে চান না। এক্ষেত্রে তারা কথিত কবিরাজ ও বৈদ্যের কাছে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেন। এক্ষেত্রে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে তাদের চিকিৎসা দিতে গেলে উল্টো ভর্ৎসনা করে রোগী ও তাদের স্বজনরা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মা ম্যাডাম নামটি শুনতে একটু অন্যরকম হলেও বিষয়টা খুবই এনজয় করি। কখনো কখনো মনে হয় যক্ষ্মা ম্যাডামের আড়ালে ডা. বিশাখা ঘোষ হারিয়ে যাবে না তো?’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘যক্ষ্মা ম্যাডামের নাম যে বিশাখা ঘোষ তা আমিও অনেক সময় ভুলে যাই। তৃণমূল থেকে সহকর্মী পর্যন্ত যক্ষ্মা ম্যাডাম এ নামেই বেশি চেনে উনাকে। আমিসহ অনেক কর্মকর্তারা উনাকে রোগী ও তাদের স্বজনদের দেখাদেখি যক্ষ্মা ম্যাডাম নামেই ডাকি।’

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম বিভাগের সাফল্য
‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’ এটাই প্রবাদ ছিল দেশে। কিন্তু যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর পদক্ষেপের কারণে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমানে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ।  বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রিভিলেন্স সার্ভের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মধ্যে যক্ষ্মা রোগী ২৬০ জন, যা আগে ছিল ৪০৪। চিকিৎসার সাফল্যের হার শতকরা ৯৫ ভাগ। দেশের যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ হারকে ছাড়িয়ে গেছে চট্টগ্রাম বিভাগ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সফলতা ৯৭ শতাংশ। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য মতে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় সফলতার হার ৯৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় গত বছর সাফল্যের হার ৯৭ শতাংশ; যা সারা দেশের তুলনায় দুই শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে সাফল্যের হার ৯৭ শতাংশ, কক্সবাজারে ৯৬ শতাংশ, নোয়াখালীতে ৯৬ শতাংশ, লক্ষীপুরে ৯৫ শতাংশ, ফেনীতে ৯৯ শতাংশ, চাঁদপুরে ৯৭ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ৯৯ শতাংশ, বান্দরবানে ৯৯ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৯৯ শতাংশ, কুমিল­ায় ৯৬ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯৫ শতাংশ। ১১ জেলায় গড় সাফল্যের হার ৯৭ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেযজ্ঞ ডা. বিশাখা ঘোষ বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রকল্পে কাজ খুবই ভালোভাবে হচ্ছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে য²া নির্মূল করার লক্ষ্যে যে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে তা সফল হবে মনে মনে করি।

পেছনের গল্প
১৯৯৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন ডা. বিশাখা ঘোষ। ২০০০ সালে তিনি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৪ সালে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষক হিসেবে যোগাদান করে। এর মাঝে চট্টগ্রাম মা ও শিশু কলেজ ও হাসপাতালসহ বেসরকারি একাধিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন। মাঝে কাজ করেন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন সাহায্য সংস্থায়। ২০১২ সালে তিনি যোগদান করেন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রকল্পে। এরপর থেকে এ প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস ও ভারতসহ বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।

সর্বশেষ খবর