মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের মিশন হাসপাতাল। প্রায় ৪০ বছর ধরে হাসপাতালটিতে মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন ব্রিটিশ নাগরিক জিলিয়ান এম রোজ। পেশায় সেবিকা রোজ অসুস্থদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি হাসপাতাল চত্বরে নিজ প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিট। বিভিন্ন এলাকার শিশুরা কম খরচে এখানে সেবা পাচ্ছে। প্রায় ২০ বছর আগে হাসপাতালে ‘জি ওয়ার্ড’ নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমও চালু করেছেন, যেখানে বর্তমানে ১৮ জন নিবাসী বিনামূল্যে বসবাস করছেন। হাসপাতালের পাশেই এলাকার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিবছর সেখানে শতাধিক শিক্ষার্থী বিনামূল্যে ও স্বল্প মূল্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে তুলেছেন কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে ১৬ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন। বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট সুজিত মুল জানান, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া রোজ সিস্টার এই মিশন হাসপাতালের প্রাণ। জিলিয়ান এম রোজ ওরফে রোজ সিস্টারের বয়স এখন ৮০ বছর ছুঁই ছুঁই। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে বাংলাদেশে এসেছিলেন। পরে ধর্মপ্রচার ছেড়ে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ৩৬ বছরের বেশি সময় ধরে এ হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রতিষ্ঠা করে মমতা দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে টিকিয়ে রেখেছেন। মানুষের সেবায় আত্মনিবেদিত এই মানুষটি এখন এলাকায় একনামে রোজ সিস্টার নামে পরিচিত। রোজের বাবা সিএ রোজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া রোজ ছোটবেলায় বাবাকে হারান। মায়ের সংসারে একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে ভালোই চলছিল রোজের। তরুণ বয়সেই নিয়ে ফেলেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত। তা হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ। ১৯৬৪ সালে ২৫ বছর বয়সে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন এ দেশে। ১৯৮১ সালে ধর্মপ্রচার ছেড়ে সরাসরি চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে মানবসেবার সিদ্ধান্ত নেন রোজ। নার্স হিসেবে শুরু করেন মানবসেবা। মাঝখানে ১৯৮৬ সালে বয়োবৃদ্ধ মায়ের সেবার জন্য দেশে ফিরে যান। তবে মা মারা গেলে ওই বছরই ফিরে আসেন বাংলাদেশে। এরপর প্রায় চার দশক ধরে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন। বর্তমানে চিরকুমারী রোজের এ হাসপাতালই ঘর-সংসার। তিনি বল্লভপুর মিশন হাসপাতাল থেকে কোনো বেতন নেন না। বরং ব্রিটিশ সরকারের কাছে যে পেনশন পান তা দিয়ে নিজের চলার পাশাপাশি বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে দরিদ্রদের সেবা দেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া কর্মচঞ্চল রোজ বলেন, মানবসেবাই হচ্ছে পরম ধর্ম। সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। আমার এ সেবার কার্যক্রমে পরিবারের লোকজনও সন্তুষ্ট। আমি যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এভাবে সেবা দিয়ে যাব। পৃথিবীতে এসেছি সেবা দিতে। বৃদ্ধদের জন্য কেউ কিছু করে না। তাই আমি নিজে একটি বৃদ্ধাশ্রম খুলেছি। সেবা দিতে গিয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আত্মার সখ্য।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবুল মল্লিক বলেন, নিজ দেশ ছেড়ে সুদূর এই দেশে মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকলেও পাঁচ বছর পর পর পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে রোজকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া এখনো পাননি। তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিলে একদিকে ভিসা জটিলতা থেকে তিনি মুক্তি পেতেন, অন্যদিকে মানবসেবী এ নারীকে প্রকৃত সম্মানও দেওয়া হতো বলে মনে করেন। নার্সিং প্রশিক্ষণের ছাত্রী মেরি মুল ও শিলা মুল বলেন, জুলিয়ান এম রোজ একটি আদর্শ। আমাদের মায়ের মমতা দিয়েই কাজ শেখান তিনি। তাঁকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে আমরাও তাঁর মতো জীবন গড়তে চাই।
মুজিবনগর বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন জানান, এখানে সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে জুলিয়ান এম রোজের এক প্রকার সখ্য গড়ে উঠেছে। মায়ের মমতা মাখা হাত দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেবা করতে গিয়েই এলাকার মানুষের হৃদয়ে এক অন্য রকম জায়গা করে নিয়েছেন রোজ। এলাকার রোগী ও সাধারণ মানুষ জিলিয়ানকে খুবই আপনজন হিসেবে দেখেন। তাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।