দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী মুগ, খেসারি ও বেসনের তৈরি মুখরোচক পাপড়ের কথা শুনলেই যে কারও জিভে জল আসে। সুস্বাদু ও মুখরোচক হওয়ায় একসময় এর চাহিদা ছিল উপমহাদেশ জুড়ে। সারা বছর গ্রামবাংলার প্রায় প্রতিটি হাটবাজারে পাওয়া যায় পাপড়। আর মেলাগুলো যেন পাপড়ের দোকান ছাড়া জমেই না।
জানা যায়, রাজা-বাদশাদের খাদ্য তালিকায়ও ছিল এ পাপড়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েক শ বছরের ইতিহাস। যে কোনো ছোট ছোট দোকানে ভাজা হয় মুগের পাপড়। ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া হয় হালকা ঝাল বিট লবণ। কোথাও ঘুরতে যাওয়া কিংবা স্কুলের টিফিনে বড় একটি পাপড় কিনে তা অল্প অল্প করে সাবধানে ভেঙে খাওয়ার দৃশ্য এখনো চোখে পড়বে। চিকন সুগন্ধি চাল, লিচু আর কাটারিভোগ চালের চিড়ার পাশাপাশি দিনাজপুরের পাপড়ের চাহিদা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। দিনাজপুর শহরের চকবাজার, নতুনপাড়া, বাসুনিয়াপট্টি, চুড়িপট্টি, রাজবাড়ি, গুঞ্জাবাড়ি, ফকিরপাড়া, বড়বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয় পাপড়। সাধারণত মসুর, ছোলা, মাষকলাই, চাল, আলু ইত্যাদির গুঁড়া ও খামি থেকে এটি বানানো হয়। তবে দিনাজপুরের মুগ ও খেসারির ডাল এবং বেসনের পাপড় বেশ বিখ্যাত। নিরামিষভোজীদের মধ্যে মুগ ডালের পাপড়ের ব্যাপক চাহিদা। তৈরির মূল উপাদান ডাল হলেও পাপড়ের স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে খামিরের সঙ্গে জিরা, মরিচ, বাদাম কিংবা কালিজিরা মেশানো হয়। মুগের পাপড় প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ৩০০ টাকা আর মাষকলাই এবং অন্যান্য ডালের পাপড় ১১০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে ঢাকায় এর দাম কিছুটা বেশি।
জনশ্রুতি আছে, দিনাজপুরের রাজপরিবারের খাদ্য তালিকায় ছিল মুগের পাপড়। ফলে এ অঞ্চলে পাপড়ের ইতিহাস কয়েক শ বছরের পুরনো। পাপড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা গেলেও পাপড় মুখরোচক নাশতার অন্যতম অনুষঙ্গ। শরতের স্নিগ্ধ বিকালে হোক বা শীতের দিন, চায়ের সঙ্গে পাপড় ভাজা কিংবা পাপড় ভেঙে দিয়ে মুড়িমাখা অথবা শুধু ভাজা পাপড় খাওয়া এক অন্যরকম স্বাদ তৈরি করে।
দিনাজপুরের পাপড় এখন ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন সুপার স্টোরে, বড় মুদি দোকানেও কেজি হিসেবে বিক্রি হয়।
লতা রানী, শ্যামলী রানীসহ কয়েকজন পাপড় তৈরির শ্রমিক জানান, সংসারের কাজের পাশাপশি প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে পাপড় তৈরির কাজ করেন। বাড়ির কাজ শেষে দিনে ১৫০-২০০ টাকার পাপড় বানাতে পারি। কিন্তু পাপড় বানানোর পর রোদে শুকাতে খুব কষ্ট হয়। খোলা জায়গায় পাপড় শুকাতে হয়। অনেক সময় ধুলাবালি, মাছি আবার বৃষ্টি হলে বিপদে পড়ি। পাপড় তৈরির জন্য যদি কারখানা থাকত, তাহলে ভালো হতো। আগে ১০০ পাপড় বানালে ১০ টাকা দিতেন ব্যবসায়ীরা। এখন ১০০ পাপড় বানালে ৩০ টাকা দেয়। কিন্তু তাতেও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। কিন্তু পাপড় শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে না। শহরের পাপড় ব্যবসায়ী দুলালসহ কয়েকজন জানায়, দিনাজপুরে পাপড় তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ জড়িত। সরকারি সহায়তা পেলে পাপড় বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।