সাগর নয় তবু ইতিহাস- ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ছয় সাগরের দিনাজপুর। অপরূপ নয়নাভিরাম দিনাজপুর ভালো লাগার পরশে ভ্রমণকারীদের মন ছুঁয়ে যায়। পৌরাণিক কাহিনির জেলা দিনাজপুরে রাজার আমল থেকে আছে ছয়টি ঐতিহ্যবাহী দিঘি। শহরের কিছু দূরে অবস্থান হলেও এসব দিঘির রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এ ছয় সাগরকে সংরক্ষিত করে আকর্ষণীয় করে তোলা হলে পর্যটকদের ভিড় বাড়বে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রামসাগর : মধ্যযুগের বিখ্যাত সামন্ত রাজার অমর কীর্তি রামসাগর যা এক ঐতিহাসিক দিঘি। দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মহারাজাদের কীর্তিময় রামসাগর। চারদিকে সুউচ্চ মাটির ঢিবি, মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন দিঘির নীল জলরাশি। পাড়ভূমিসহ এ দিঘির মোট জমির পরিমাণ ১৪৬ একর। বাংলোর পাশে একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন রঙের হরিণ, বানর, পাখিসহ কিছু পশুপাখি রয়েছে। এর পাশে রয়েছে শিশুদের জন্য পার্ক। সেচ-সুবিধা, প্রজাদের পানির কষ্ট দূরীকরণ এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও সংস্থান হিসেবেই রাজা রামনাথের আমলে এ দিঘিটি খনন করা হয়।
পদ্মসাগর : দিনাজপুরের রাজবাড়ির ভিতরে অবস্থিত পদ্মসাগর। জানা যায়, রাজবাড়ির নারী ও রাজ কুমারীরা এ সাগরের পানি পান করতেন। বাঁধানো ঘাট ও গভীরতার জন্য পদ্মপুকুরটিকেও অনেকে সাগর বলে থাকেন। তবে এটি আয়তনে ছোট। রাজবাড়ির ভিতরে রানি ভবনের সঙ্গে পদ্ম সাগরটি এখন মানুষকে দারুণ আকৃষ্ট করে। তবে রাজবংশের কোন রাজা কোন সময় যে পদ্ম পুকুর খনন করেছিলেন তা জানা যায়নি। পুকুরটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। রাজবাড়িতে কমপক্ষে পাঁচটি মন্দির ছিল। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হতো, আর সে কারণে প্রয়োজন পড়ত প্রচুর ফুল। জনশ্রুতি আছে, সেসব পূজার জন্য প্রচুর পদ্ম ফুলের চাহিদা ছিল। ফুলের জোগান নিয়মিত রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ পুকুরে পদ্ম ফুলের চাষ করা হতো। ফুলও ফুটত অনেক। সে থেকে পুকুরের নামই হয়ে গেল পদ্ম পুকুর।
সুখসাগর : দিনাজপুর শহর থেকে সড়কপথে উত্তর পূর্বদিকে ২ কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি অবস্থিত। আর রাজবাড়ি থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে এ ‘সুখসাগর’ অবস্থিত। চারদিকে শাল ও আকাশমণি বাগান আর দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, যেন শহরের ব্যস্তময় জীবনে একটু শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়। স্বচ্ছ জলরাশি, দিঘিতে মাছের সাঁতার কাটা ও লাফালাফি এ সাগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। নৌকায় চড়ে সাগরে ভ্রমণের কিছুটা স্বাদও নেওয়ার সুযোগ আছে এখানে। সাগরের পাড় যেন ছোট একটা পাহাড়ের মতো। শীতকালে বসে অতিথি পাখিদের মেলা। পাড়ে দাঁড়ালেই শোনা যাবে অতিথি পাখির কিচিরমিচির। অতিথি পাখিদের কোলাহলে মুখরিত সুখসাগর। এতে প্রকৃতি প্রেমিকদের আনাগোনাসহ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এর কদর বেড়েছে।
আনন্দ সাগর : দিনাজপুর শহরের অদূরে আনন্দ সাগরের অবস্থান। এখানে প্রতিবছর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গোষ্ঠ পূজা হয় এবং এক দিনের মেলাও বসে। জনশ্রুতি আছে, দিনাজপুরের তৎকালীন রাজা রামনাথ রানিকে নিয়ে সোনার নৌকায় রাজবাড়ি থেকে পানিপথে নৌবিহারে এ দিঘিতে আসতেন। এ জন্যই এর নাম হয়েছে আনন্দ সাগর। আনন্দ সাগরের সঙ্গে একটি নালার মাধ্যমে সুখ সাগরের সংযোগ ছিল। যদিও পানি প্রবাহের নালাটি আগের মতো নেই। বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘরসহ দখলের কারণে নালাটি অস্তিত্ব সংকটে। তাই এখন আনন্দ সাগরের সঙ্গে নালার সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
মাতাসাগর : দিনাজপুরের রাজা রামনাথের সময়ে খনন করা হয়েছে মাতাসাগর। সুখসাগর থেকে উত্তরে এ দিঘির অবস্থান। মাতাসাগরের নৈসর্গিক পরিবেশ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এখন পাড়ের উচ্চতা কমে গেছে। এ মাতাসাগরকে লিজ দেওয়ার পর থেকে দর্শনার্থীদের যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
জুলুমসাগর : ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে এ দিঘিতে অত্যাচার করত বলে নাম হয়েছে জুলুমসাগর। ইতিহাস বেত্তা মেহরাব আলীর বই থেকে জানা যায়, জুলুমসাগর দিনাজপুর গোর-ই-শহীদ বড় ময়দানের পশ্চিমে একটি সুলম্বিত পুরাতন দিঘি। হয়তো একদা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত উন্নতিকল্পে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা জুলুম করে এই দিঘি খনন করা হয়-তাই এর নাম জুলুম সাগর।