রাজকীয় নকশা খচিত মাটির ডুপ্লেক্স বাড়িটির বর্তমান মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত বলেন, ১৮২৩ সাল নাগাদ জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের বাবা পাল বংশের কাছ থেকে একটি মাটির দোতলা বাড়ি খরিদ করেন। সেই সময়ে জমিদারির প্রায় সব কার্যক্রম চালানো হতো এই বাড়ি থেকেই। সে সময় জমিদার খুব বিনোদনপ্রিয় ছিলেন। ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এই বাড়ির উঠানেই বসত যাত্রাপালা। এখানে উচ্চ বংশীয় এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে পুজোর সময় সংস্কৃতি লড়াই হতো। মৈনম বাজারের জমিদার বাড়ি এখন আধুনিক মাটির ডুপ্লেক্স বাড়ি। ব্যক্তি মালিকানায় থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক আসেন বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ২০২১ সালে রায় বাড়ির বংশধর বরুণ রায় এবং বাবন রায় জমি বিক্রি করে নাটোরে চলে যান। বর্তমানে ক্রয়সূত্রে বাড়িটির মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত। বাড়িটি সংস্কারে আধুনিকায়নে শান্ত স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারিগরদের শৈল্পিক কারিগরিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাড়িটির বর্তমান নাম রাইজিং হেরিটেজ প্যালেস। এখনো মাটির চিহ্নগুলো রয়ে গেছে। বাড়ির দেয়ালগুলোতে মাটির স্তর দিয়ে নানান শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নিয়ামতপুরের আদিবাসী পল্লী থেকে ৮০-৮৫ বছরের বৃদ্ধ দ্বিজেন বর্মণ তার ২০ জনের একটি দল নিয়ে চার মাস শিল্প কর্মের কাজ করেছেন।
পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় কারিগর দিয়ে প্রায় দুই বছরে এমন রূপ দিতে পেরেছেন। বাড়িটিতে অভ্যন্তরীণ দুটি মাটির সিঁড়ি রয়েছে যা প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। আর সংস্কারের পর বাহির থেকে সবার চলাচলের সুবিধার্থে সিঁড়ি করা হয়েছে। কথিত রয়েছে, জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের দুই ছেলে ছিলেন। বড় ছেলের নাম বড়দা প্রসাদ রায় এবং ছোট ছেলের নাম শরৎ রায়। বড়দা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো বড় তরফ আর সারদা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো ছোট তরফ। এই বড়দা প্রসাদ রায় তৎকালীন ১৯৪২ সাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অর্থাৎ এখনকার ভাষায় যেটাকে বলা হয় চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে মোজাহার ডাকাত ও ইরফান ডাকাতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এখানে। সেই দাঙ্গায় এই পরিবারের ১৩ জন সদস্য নিহত হন। মৈনমের ১৯৬৪ সালের রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস একুশে পরিষদ নওগাঁ লিপিবদ্ধ করেছে। সে সময় জমিদার বড়দা প্রসাদ রায়ের স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বড়দা বাবু প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এ এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর রায় পরিবারের সদস্যরা এক এক করে বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। সর্বশেষ এখানে ছিলেন বরুণ রায় এবং বাবন রায়। দর্শনার্থীরা বলেন, বাড়ি নওগাঁ সদরে হলেও এই বাড়িটির কথা অনেক শুনেছি, তাই দেখার জন্য এসেছেন। এখন মাটির বাড়ি বিলুপ্তির পথে। বাড়িটি মাটির হলেও একটা রাজকীয় তথা জমিদারি ভাব আছে, যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করেছে। দর্শনার্থীরা হারানো এমন স্মৃতিকে ধরে রাখতে মোবাইলে ফোনে সেলফি তোলেন আবার অনেকে ভিডিও বানান। স্থানীয়রা বলেন, বাড়িটির আগে এমন সৌন্দর্য ছিল না। গত বছর বাড়িটির সংস্কার ও নকশার কাজ শুরু করে। যা সম্পূর্ণ হওয়ার পর অনেক দর্শনার্থী দেখতে আসেন। বাড়িটির সামনের অংশে পানির ফোয়ারা, বসার সুব্যবস্থা রয়েছে।