দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে কৃষি, শিল্প, তৈরি পোশাক, পরিবহন, আবাসন, চামড়া ও চিংড়ি, শিক্ষা-প্রযুক্তি খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপক অবদান রয়েছে। একইভাবে, এই ব্যাংকের সম্মিলিত পরিসম্পদ, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ, ক্ষুদ্র ও কৃষি বিনিয়োগ, দারিদ্র্যবিমোচন, আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, ইসলামী মূলধন বাজারের বিকাশ, নৈতিক ব্যাংকিং, বিনিয়োগ বৈচিত্র্য প্রভৃতির নিরিখে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অবদান বিশেষভাবে মূল্যায়নযোগ্য। আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভূমিকা বিস্ময়কর, যা এ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া ইসলামী ক্রেডিট কার্ড, এটিএম, সিআরএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এসএমএস ব্যাংকিংসহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নানা প্রোডাক্টের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফল অংশীদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বিগত মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের ১৬৭২টি শাখা, ১৫টি প্রচলিত ব্যাংকের ৩১টি শাখা এবং ১৬টি প্রচলিত ব্যাংকের ৬৪৬টি উইন্ডো দেশে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। এ সময় ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানত, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা এবং ২৫ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ২৬.২৩ শতাংশ, বিনিয়োগের ২৮.২৪ শতাংশ এবং রেমিট্যান্সের ৩৭.৫২ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়; বরং এর সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের সমন্বয় করে। ইসলামী ব্যাংক যেমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তেমনি এটি সামাজিক ও নৈতিক প্রতিষ্ঠানও। এ ব্যাংক শুধু নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে না, বরং নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি মনে করে। কেননা, নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন যথার্থ কোনো সুফলই দিতে পারে না। কাজেই ইসলামী ব্যাংক নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই কাজ করে। পাশাপাশি সামাজিক স্বার্থ ও ন্যায়বিচারের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে। অন্যদিকে সহজাতভাবেই ইসলামী ব্যাংক কৃত্রিম লেনদেনের পরিবর্তে বাস্তব সম্পদভিত্তিক লেনদেন পদ্ধতির অনুসরণ করে এবং অধিক মুনাফার আশায় সমাজের জন্য ক্ষতিকর এমন প্রজেক্টে বিনিয়োগ না করে কল্যাণধর্মী ও পরিবেশবান্ধব খাতে বিনিয়োগ করে, যা অর্থনীতিকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার পাশাপাশি জনপ্রিয় ও সর্বজনীন ইসলামিক ব্যাংকিং ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর পাশাপাশি অমুসলিম দেশগুলোতেও বাড়ছে এর আধিপত্য। এর সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বের নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্যাংকও ইসলামী উইন্ডো চালু করেছে। এমনকি লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, সিঙ্গাপুর, টোকিও এবং টরন্টোর মতো প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার কেন্দ্রগুলোতে ইসলামী অর্থায়ন মডেলের উপস্থিতি বেগবান হচ্ছে। স্ট্যাট অব গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমির রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে ৬ শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ষাটের দশকে প্রথম মিসরের মিটগামারে ক্ষুদ্র পরিসরে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সূচনা হলেও আশির দশকে বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়। এই ব্যাংকিংয়ের প্রতি এ দেশের মানুষের বিপুল সমর্থন ও আগ্রহ থাকায় পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রচলিত ব্যাংকগুলো ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো খোলে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে ইসলামিক ব্যাংকিং ধারা আজ বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও আর্থিক লেনদেনে ইসলামিক ব্যাংকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে।
দ্রুত বিকাশমান ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার সাফল্য ও জনপ্রিয়তার অন্তর্নিহিত কারণ কী? এটা কি শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণে, নাকি এর অন্তর্নিহিত কোনো অর্থনৈতিক ন্যায্যতা রয়েছে? অনুসন্ধানী অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকিং বোদ্ধা ও গবেষকরা ইসলামিক ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতির সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার কারণ উল্লেখ করেছেন তা হলো-
♦ গ্রাহকের আস্থা ও মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ব্যাংকিং বেশ সম্ভাবনাময়।
♦ আর্থিক লেনদেনে সুদ পরিহার করার কারণে ইসলামিক ব্যাংকিং শোষণমুক্ত ও টেকসই অর্থনীতি বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে
♦ প্রচলিত ব্যাংকিং চর্চায় পুঁজিদাতা ব্যবসায়িক ঝুঁঁকি বহন করে না। সুবিচার নিশ্চিত করতে মূলধনের মালিককে ঝুঁঁকি বহন করতে হবে, যা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
♦ অর্থের ব্যবহারকে তার উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমিত রাখার মাধ্যমে আছে প্রকৃত কল্যাণ। যা এই ব্যাংকিংয়ে সবাইকে আকৃষ্ট করে।
♦ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টারমেডিয়েশনের প্রধান লক্ষ্যই হলো অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, যা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
♦ ইসলামী ব্যাংক মুনাফা সর্বোচ্চকরণ নীতির পরিবর্র্তে সমাজের প্রয়োজন পূরণের দিকে নজর দেয়, যা মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়ে থাকে।
♦ লাভ-লোকসান অংশীদারি মডেলের পাশাপাশি বাস্তব লেনদেনভিত্তিক বাই মুরাবাহা, বাই সালাম, বাই ইসতিসনা ও ইজারার মতো অর্থায়ন পদ্ধতির চর্চা, যা রিয়াল ইকোনমি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
♦ সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের মাধ্যমে ইনসাফপূর্ণ বণ্টননীতির চর্চা, যা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাম্য সমাধান। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর কিছু আদর্শগত আর কিছু কার্যক্রম ও ফলাফলের ক্ষেত্রে। ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহর নীতিমালা অনুসরণ করে কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকে তার প্রয়োজন নেই।