শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমি স্বপ্নচারী ভুলোমনা কিন্তু জুঁই চটপটে

আমি স্বপ্নচারী ভুলোমনা কিন্তু জুঁই চটপটে

টিভি, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন অঙ্গনের জনপ্রিয় মুখ মোশাররফ করিম। সাবলীল অভিনয়ের কারণে তিনি দর্শকনন্দিত। এক সময় চুটিয়ে থিয়েটার করেছেন। অন্যদিকে মোশাররফ করিমের স্ত্রী রোবেনা রেজা জুঁই একচেটিয়ে কাজ করছেন নাটক ও চলচ্চিত্রে। এক সময়ের শিক্ষক ও সহকর্মী মোশাররফ করিমের সঙ্গে প্রায় পনেরো বছর একই ছাদের নিচে সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের আড্ডা আয়োজনে এই তারকা দম্পতি নিজেদের জীবন ও অভিনয় বিষয়ে কথা বলেছেন। তাদের আড্ডা তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল

 

থমথমে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের লাবণী শুটিং হাউস। কায়সার আহমেদের ‘চাঁন বিরিয়ানি’ ধারাবাহিকের শুটিং চলছে। তবে রোবেনা করিম জুঁইয়ের শট লাঞ্চের পর। অভিনয় করছেন পুরান ঢাকার রাজিয়া চরিত্রে। যেখানে তার মামা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আবুল হায়াত। বাবা-মা নেই বলে এই মামার কাছেই তিনি মানুষ হয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ধারাবাহিকে কাজ করছেন তার ভালোবাসার মানুষ মোশাররফ করিমও। তবে তার সঙ্গে জুঁইয়ের তেমন সিকোয়েন্স নেই বললেই চলে! তো যাই হোক অনেক দিন থেকে মোশাররফ করিম ও জুঁই দম্পত্তির সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য সময় মেলাতে বৃথা চেষ্টার পর শোবিজ টিম সরাসরি সেদিন হাজির হয়েছিল শুটিং সেটে। সেদিন দুজনেরই শুটিং চলছিল উত্তরায়। তবে আউটডোরে শুটিং থাকায় মোশাররফ করিম আসতে বললেন দিয়াবাড়ীতে। তাই আমাদেরও একটু কৌশলী হতে হলো। জুঁই ভাবীর সঙ্গে আড্ডা ও ফটোসেশন শেষ করেই দিয়াবাড়ীতে মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করলাম। বেশ কয়েকবার জুঁই ভাবীও ফোনে মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেন। হঠাৎ জুঁই ভাবীর ফোন কনভারসনের একটা সম্বোধনে মজা করে তাকে বলেই ফেললাম, ভাবী, মোশাররফ ভাইকে কি আপনি ‘বাবুন’ নামেই ডেকে থাকেন? ভাবী মুচকি হেসে কোনো দ্বিধা না করেই উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, সেও আমাকে এই নামেই ডাকে। জুঁই নামেও ডাকে। বিয়ের আগে থেকে এমনিতেই তাকে আপনি বলতাম। বিয়ের পরও এই আপনি ব্যাপারটা ছিল প্রায় ৬-৭ মাস।’ তার সঙ্গে পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা কীভাবে হলো? জুঁই ভাবী এবার কথার ঝাঁপি খুলে বসলেন, ‘এটা আসলে এখন কারও কাছে অজানা নেই; মোটামুটি সবাই জানেন। পরিচয়টা প্রথম হয়েছিল একটি কোচিং সেন্টারে। শামীম (মোশাররফ) তখন সেখানে পড়াতেন। সেখানে আমি কোচিং করতাম। সে সময় তাকে ভাইয়া বলে ডাকতাম। এক সময় আমিও সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। তখন তিনি হয়ে গেলেন আমার সহকর্মী। এরপর তো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।’ প্রেমের অফারটা কে প্রথম দিয়েছিল? ‘তার দিক থেকেই প্রথমে প্রস্তাবটা এসেছিল। তিনি তো অনেক আগে থেকেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, কিন্তু তা প্রকাশ করেননি।’ অকপটে একটানা কথাগুলো বলে গেলেন জুঁই। প্রেম নিবেদনে বা ভালোবাসা হওয়ার পর তার থেকে কতগুলো চিঠি পেয়েছেন? লাজুক হেসে উত্তরটা দিলেন জুঁই, ‘আসলে তিনি তো কিছুটা চাঁপা স্বভাবের। চিঠি লেখা, কার্ড বা ফুল দেওয়া-এসব কিছু তিনি করতেই পারতেন না (খিলখিল করে হেসে)। উপরন্তু জোর করে তাকে নিয়ে রিকশায় উঠে কোনো দোকান থেকে ফুল কিনে তাকে দিয়ে বলতাম, এবার আমাকে দাও।’ বিয়েটা কত বছর পর হয়? জুঁই ভাবীর ঝটপট উত্তর, ‘চার বছর পর। ২০০৪ সালে আমরা বিয়ে করি।’ দাম্পত্য জীবন তো তাহলে দীর্ঘদিনের... ‘হুমম! আর কিছুদিন পর সাড়ে ১৪ বছর পেরিয়ে ১৫ বছরে পড়বে।’ সামনেই তো ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডে। দিনগুলো নিয়ে দুজনের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে? ভাবীর হেসে উত্তর, ‘তার হয়তোবা এ নিয়ে কোনো খেয়াল থাকবে না। তবে আমি কেক, ফুল দিয়ে তাকে উইস করতে পারি।’ একসঙ্গে রাস্তাঘাটে ঘুরতে বা কেনাকাটা করতে বের হলে কেমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়? তার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘তার ক্রেজ তো অনেক বেশি! বিড়ম্বনায় তো পড়তেই হয়। তার জনপ্রিয়তা এতটাই আকাশচুম্বী যে, তাকে দেখলে ভক্তদের কোনো হুঁশ জ্ঞান থাকে না। আর এসব তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকে না।’ মোশাররফ ভাই কি বাজার করেন? বাজার করেন না বলে জানালেন জুঁই ভাবী। বললেন, ‘মাঝে মাঝে আমি বাজার করি। তিনি কোনো সময় বাজারে যান না।’ দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি তো হয়। কে আগে অভিমান ভাঙায়? কথাটি শুনে কি বলবেন তা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ভাবীর উত্তর, ‘ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান তো থাকবেই। তবে একটা ব্যাপার কি, আমাদের দুজনের মধ্যকার ঝগড়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমরা দুজন দুজনকে বুঝি। ভুল হলে ‘সরি’ বলি তাড়াতাড়ি। যার দোষ সে দ্রুত স্বীকার করে নেয়।’ মোশাররফ ভাই তো বেশির ভাগ ফানি চরিত্র করে থাকেন। বাসায়ও কি সবার সঙ্গে ফান করেন? একটু হেসে জুঁই ভাবী বললেন, ‘তিনি অভিনয়ে ফানি চরিত্র করলেও বাসায় একেবারেই অন্যরকম। তবে আমার সঙ্গে অনেক বিষয় শেয়ার করেন, ফান তো করেই। হুট করে পরিচয় হওয়া কোনো লোকের সঙ্গে চাইলেও ফান তো আর করতে পারেন না। তার সার্কেল এখন অবশ্য খুবই লিমিটেড। তবে শুটিংয়ে তিনি প্রচুর ফান করেন।’ রোবেন রায়ান করিম মানে ছেলেকে কি তিনি স্কুলে নিয়ে যান? ভাবীর উত্তর, ‘না সেটা সম্ভব হয় না তার। তবে স্কুলের কিছু প্রোগ্রামে তিনি বাচ্চার সঙ্গে গিয়েছেন।’ মোশাররফ ভাই তো ভালো গান গাইতে পারেন। গানও সুন্দর লেখেন। তিনি চমৎকার ফটোগ্রাফিও করেন... ভাবী বললেন, ‘মোশাররফের অভিনয়ের গুণ তো অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু ওর লেখার হাত অসাধারণ। গানও ভালো গান। তবে আমি চাই, ভবিষ্যতে তাকে লেখক হিসেবে দেখতে।’ ভাবীর কাছ থেকে জানা গেল, মোশাররফ ভাইয়ের এন্টিক জিনিসের প্রতি রয়েছে অনেক দুর্বলতা। তার একটি গাড়ি রয়েছে আরটিফোরটি, ১৯৬৮-এর মডেল। তার কালেকশনে বেশ কিছু পুরনো দিনের ক্যামেরা রয়েছে, টাইপরাইটার রয়েছে, ঘড়ি আছে। অন্যদিকে অভিনয় ছাড়াও ভাবীর রয়েছে গানের প্রতি দুর্বলতা।

ভাবীর সঙ্গে আড্ডার সমাপ্তি টেনে ছুটতে হলো দিয়াবাড়ীর দিকে। মধ্যগগনের সূর্য হেলে পড়ার আগেই পৌঁছলাম মোশাররফ ভাইয়ের শুটিং সেটে। সেখানে মোশাররফ ভাই সেজেছেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সাজে। পরেছেন রং-বেরঙের পোশাক। তার সঙ্গে রয়েছে অর্ষা। জানা গেল, এটি আশরাফুজ্জামানের নির্দেশনায় ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এখন ঢাকায়’ নাটকের শুটিং। শুটিংয়ে তিনি সময় করে কথা না বলতে পারলেও এক সময় কাছে এসে বললেন, ‘মনে হয় না এখানে কথা বলতে পারব। ভালো হয় এখানকার শুটিং শেষ করে আপনঘরে যাই। সেখানে বসে জম্পেস আড্ডা দেওয়া যাবে। কি বল?’ আমরাও সায় দিলাম তার কথায়। শুটিংয়ের সময় তিনি যে কতটা সিরিয়াস ও প্রফেশনাল তা অনুধাবন করলাম। মনে মনে এসব ভালো মানুষের জন্য মনের ভাণ্ডারে কিছুটা ভালোবাসাও জমা পড়ল। শুটিং শেষ হলে ডুবন্ত সূর্য আর মোশাররফ ভাই সমেত প্রাইভেটকারটি আমাদের সঙ্গী করে ছুটে চলল আপনঘরের দিকে। গাড়ি ছুটছে, পাশে বসা মোশাররফ করিম। তিনি নিজে থেকেই আপনমনে গেয়ে চললেন সুন্দর কথামালার একটি গান। ‘বুঝলাম না কারবার, ক্যামন খেলা কেবা খেল আর; শূন্য থেকে আসে মানুষ শূন্যে চলে যায়, আরে বোঝে না বোঝে না মানুষ বীজগণিত শিখায়...’ বাহ, আপনি তো ভাই চমৎকার গান! গানটি লিখেছেন কে? মোশাররফ ভাই কথাটা শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘এটি আমার লেখা সর্বশেষ গান। আর এক সময় তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা ডিপার্টমেন্ট আমার লেখা তিনটি নাটক মঞ্চস্থও করেছে। তবে মিডিয়ার জন্য কোনো নাটক লেখাই শেষ করতে পারিনি। লিখছি কিন্তু ভালো লাগেনি। সেটা আবার ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। এখন অবশ্য একটি লিখছি।’ কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, নাটকটির নাম কি? ‘তালাক!’- এক কথায় উত্তরটা দিলেন। এরপর আবার বলে চললেন, ‘ট্রেনে ফিরতিছিলাম। সবাই ঘুমাই গেছে। তো বাইরে বিল। বিলের মধ্যে একলা একটি বক। বকডা দেহেই মনের ভিতর কেমন যেন লাগল। তহন বক নিয়াই একটা গান ট্রেনের মধ্যেই বাইন্ধ্যা ফেললাম। তবে লাস্ট প্যারাডা আর লেহা হয় নাই। আসলে যা হয় তা একবারেই লেখে ফেলা উচিত। বহু বছর হলো। তাও প্রায় ১৫ বছর হইল।’ এরপর তিনি বক নিয়ে তার অসম্পূর্ণ গানটি গাইতে শুরু করলেন। ‘ধবলা বকরে রে বক ধবলা বক, নীলের কোলে ভাস তুমি, জলে রাখ ছায়া; এ কেমন মায়া রে বক, ধবলা বক... গানটি শেষ হতেই তিনি নিজে থেকেই বলে চললেন, ‘বুঝি না রে বুঝি না! সেই ছোটবেলায় এইডা লিখছিলাম। তখন গানের কথাগুলো এমনিতেই মনের চিত্রপটে ধরা দিত। আহা, সেই সময়!’ বুঝলাম, মোশাররফ ভাই আজ অনেক আনন্দেই আছেন। ‘আহারে সোনার পুতুল কে বানিয়া যায়, কোনবা টানে ছাড়লা মায়া, চড়লা কোন বিদিশানায়... তিনি গানটাকে ছন্দে ছন্দে আবৃত্তি করতে লাগলেন। বললেন, ‘ওই দলে থাকলে লেখা হতো। এহন তো হতে চায় না রে! ইন্টারমিডিয়েট থাকাকালীন বান্দর ছিলাম। এখন তো মিডিয়ায় ঢুকে ট্যাকার লাগি বন্দী হইয়া গেছি। তবে কবিতা নিয়ে অনেকেই বই বের করতে বলে। আমার লজ্জা লাগে।’ আবার তিনি নিজের লেখা প্রেমের কবিতা আওড়াতে লাগলেন। ‘তোমাকে কি করে টেনে নেওয়াই ডালের পাঁচফোড়নে, লোহার বাসরে সুতানালী গলদ...।’ এক আধ্যাত্মিক মোশাররফকে খুঁজে পেলাম। এরমধ্যে কথায় কথায় জানা হয়ে গেল, তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন এবং কিছু কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। তবে তার আক্ষেপ ছিল যে, কেন তার কবিতা অন্য কবিদের লেখা কবিতার মতো মূল্যায়ন করা হলো না! ‘তারকাদের কবিতা’ শিরোনামে কেন তার কবিতা বন্দী করে ছাপানো হলো। ভাবীর প্রেমে পড়লেন কীভাবে? প্রশ্নটা শুনে অকপটে বলে চললেন, ‘সে আমার ছাত্রী থাকাকালীনই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম বলা যায়। কিন্তু কখনো প্রকাশ করিনি। তবে জুঁই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগেই আমি তাকে মনের কথা বলি।’ ভাবীর অভিযোগ, তাকে সময় দেন না? তিনি মুচকি হেসে অভিযোগের ব্যাপারে সায় দিলেন। আপনি কেমন ধরনের? ভাবী স্বভাবে কি আপনার বিপরীত? বললেন, ‘আমি তো স্বপ্নচারী, ভুলোমনা। তবে জুঁই কিন্তু অনেক চটপটে। অনেক কাজ একসঙ্গে করতে পারে।’ ছেলে রায়ানকে নিয়ে স্বপ্ন কি? প্রশ্নটা শুনে কি এক প্রশান্তিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখলাম। ‘জুঁই ও আমার ভালোবাসার ফসল রোবেন রায়ান করিম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে না চাইতেই আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। দুজনই স্বপ্ন দেখি আমাদের ছেলেকে নিয়ে।’ আড্ডার সমাপ্তি টানতে মন চাইছিল না যেন। এই ভালোবাসার দম্পতির জন্য চাওয়া ছিল, তাদের মাথার ওপরে সব সময় যেন থাকে ভালোবাসার একখণ্ড মেঘ। দুজনের অভিমানের সময় সেই মেঘ এসে বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দেবে বার বার।

সর্বশেষ খবর