২২ অক্টোবর, ২০১৫ ১০:৩৯
দিল্লির চিঠি

কৌশলগত নীরবতার সুফল

এম জে আকবর

কৌশলগত নীরবতার সুফল

গণমাধ্যম আর সরকারের মধ্যে যে সম্পর্ক তা যে কোনো গণতন্ত্রের অবশ্যই একটি জোড়া বাস্তবতা। তারা ক্ষমতার দুই মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কখনই আলাদা মেরু নয়। পরিস্থিতির দরুন তাদের মেজাজ-মর্জির ভিন্নতা দেখা যায়, পারস্পরিক মুগ্ধতা থেকে শুরু করে সে সম্পর্ক সন্দেহ, এড়িয়ে চলা, নাক সিটকানো পর্যন্ত গড়ায়; চরমে গেলে তো বৈরিতাও দেখা দেয়। কোনো কোনো সময় তাদের স্বার্থের সংঘাত চলে। অন্য সময়, ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে, অযৌক্তিক জেদ বিচক্ষণতাকে বাধা দেয়। এই যে চলমান ক্রিয়া, এর ভিতর সব সময় গরজের উপ-বুনন লুকিয়ে থাকে এবং সেই গরজটা হতে পারে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক। কাজেই, সরকার ও গণমাধ্যমের মধ্যকার সম্পর্কটাকে সাবধানে নাড়াচাড়া করা উচিত। কিন্তু দেখা যায়, এ সম্পর্কটা ঘন ঘন বেপরোয়া মানসিকতার শিকার হয়। সম্পর্ক উন্নত করবার কাজ শুরুর আগে কী কী করণীয় তা স্থির করাটা গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক সরকার সেন্সরশিপকে উপায় বলে মনে করে না। এ ক্ষেত্রে ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’র স্থান নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে আপস-অযোগ্য অধিকার। এমন উপলক্ষও আসে যখন সাংবাদিকতা ভণ্ডামিপূর্ণ ভাষার মতোই হলদেটে হয় এবং সরকারেরও থাকতে পারে সংক্ষুব্ধ-সঞ্চারণের বিষয়াদির একটা তালিকা যার বিস্তৃতি কাশ্মীর থেকে কচি পর্যন্ত, কিন্তু নিষ্পত্তির একমাত্র পথ হচ্ছে আইনানুগ প্রতিকার সাধন। সেন্সরের নিষ্ঠুর ছোরাকে আইন অনুমোদন দেয় না, দেবেও না। সেন্সরশিপ অনৈতিক, বেআইনি ও অকেজো এক পন্থা। তাহলে? গণতন্ত্রে এমন একটা কাঠামোও আছে যা ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার পথ করে নেয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, প্রাপ্তির আশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাংবাদিকের নিজের ওপর নিজে সেন্সরশিপ আরোপ করা। এটা হাতেনাতে ধরাটা, সংগত কারণেই, খুব কঠিন। গণমাধ্যমের জন্য ঝুঁকিময় হচ্ছে এই যে, কাজটা (আÍ-সেন্সরশিপ) একবার প্রমাণিত হলে চিরকালের জন্য বিশ্বাসযোগ্যতা চলে যায়। শল্যচিকিৎসা করেও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা যায় না। দর্শক-পাঠকরা গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেললে সেই প্রকাশনা বা চ্যানেলের জীবনচক্র খতম। সাংবাদিক ও রাজনীতিকের মধ্যকার সমীকরণ যাচাই হয় গণমাধ্যম হাতিয়ারের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক হাতিয়ার অর্থাৎ কথাবার্তা দিয়ে। বিস্ময়কর মনে হলেও মানতে হবে অব-দ্য-রেকর্ড যে বাক্যালাপ চলে, সেটাই হয়ে যায় সবচেয়ে ফলপ্রসূ। রাজনীতিক ও সাংবাদিকের চূড়ান্ত বন্ধন তো এটাই, যাকে বলা যায় বিশ্বাসের বন্ধন। যে সাংবাদিক এ বিশ্বাস ভঙ্গ করেন তার কানাকড়িও মূল্য নেই। অনুরূপভাবে অব-দ্য-রেকর্ড আলোচনার মাধ্যমে জনজীবনকে যিনি বিভ্রান্ত করেন তিনি নিচুমনা, অগভীর। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কেউই সবকিছু খোলাসা করেন না। তাই বলে তিনি বিভ্রান্তি তৈরি কিংবা বক্তব্য বিকৃত করবেন? না, তা করতে পারেন না। সাংবাদিকরা ও রকম আস্থার অন্যায় ব্যবহার করেছেন এমন ঘটনাবলি অবশ্যই আছে। তবে দেখা গেছে যে, তারা যার বিশ্বাসের অপব্যবহার করলেন সেই ব্যক্তির চাইতে শেষতক তারা নিজেকেই বেশি জখম করেছেন।

অস্বস্তিকর সমস্যা হচ্ছে অন-দ্য-রেকর্ড সাক্ষাৎকার। নিয়মবিধি সোজাসাপ্টা হলেও সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজটি এখনো একটি সূ² শিল্প। সাংবাদিকের সেই জ্ঞান থাকা চাই যা হবে কায়দা করে প্রশ্ন ছোড়ার সহায়ক এবং এতে করে, মূল বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার মতলবে উত্তর দেওয়া হলে, সাংবাদিক চটজলদি উত্তরদাতার স্ববিরোধিতা ধরে ফেলতে পারবেন। গৎবাঁধা প্রশ্নের একটা তালিকা নিয়ে মাঠে নামা সাংবাদিক হলেন ‘প্রাণহীন’ সাক্ষাৎকার গ্রহীতা; কথার পেছনে কথা সাজিয়ে সংবদ্ধ প্রশ্নবাণ নির্মাণের নৈপুণ্য তার নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক যে, সাক্ষাৎকারদাতা শুধু ওইটুকু তথ্যই দেবেন যা তার স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু তিনি যা বললেন না, তা বলতে তাকে উসকে দেওয়ার উপায়ও তো রয়েছে।

গোসসা কোনো জবাব নয়। অসাবধানী মন্তব্য করতে প্ররোচনার জন্য দোষাবলি দেখিয়ে প্রশ্ন ছোড়া যায়। কিন্তু ঝানু রাজনীতিক নির্বিকারচিত্তে ওসব প্রশ্নবাণ ঠেকিয়ে দেয়ার মুনশিয়ানা ধরেন। যে চাতুরীটা আমার পছন্দের তা হলো কৌশলগত নীরবতা। যতদূর সম্ভব খুব শান্ত মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করতে হবে। একটা উত্তর পাওয়া যাবে। উত্তরটা অসম্পূর্ণ বা ইচ্ছাকৃত সংক্ষিপ্ত মনে হলে নীরবতা অবলম্বনই শ্রেয়। নীরবতার ভঙ্গিটা হবে ‘অপেক্ষায় আছি, উত্তরটা পুরোপুরি দাও’। নীরবতার সামনে বসে থাকা সাক্ষাৎকারদাতা কঠিন অবস্থায় পড়ে যাবেনই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এ ধরনের নীরবতাজনিত শূন্যতা পূরণের জন্য উত্তরদাতা কিছু একটা করে বসেন। তিনি এমন মন্তব্য অথবা এমন কাহিনী বর্ণনা করেন, যা সাক্ষাৎকারকে করে তোলে প্রাণবন্ত। এ কাজটা অবশ্য খুব সহজ ছিল সেকালে, যখন ছিল প্রিন্ট মিডিয়ার আধিপত্য। মুদ্রিত সাক্ষাৎকারের সে দিন নেই। টেলিভিশনের রয়েছে বিস্তর শক্তি, কিন্তু সেই সঙ্গে গুরুতর দুর্বলতাও সে ধারণ করে। নীরবতা অবলম্বনের সুযোগ ও সময় টেলিভিশনের নেই। টেলিভিশনে শেষ কথা হিসেবে কিছু একটা বলতে হয় সাংবাদিককেই। এটা অপরিহার্য। এর ফলে, সাংবাদিকের লক্ষ্যবস্তুটা পার পেয়ে যায়। দৃষ্টিকটু একটা ব্যাপার তো ঘটেই চলেছে; টেলিভিশন চিল্লাচিল্লিকে উৎসাহিত করে। দর্শক-শ্রোতারা সংলাপের চাইতে বিতণ্ডাতে বেশি আগ্রহী, এমন ধারণা থেকেই এই বন্দোবস্ত।

প্রশ্ন করাটা গণমাধ্যমের কর্তব্য অবশ্যই। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে প্রশ্নের ভিতর যেন দুশমনী-গন্ধ না থাকে। ও রকম প্রশ্ন পেলে রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। রাজনীতিকই শুধু নন, নাস্তানাবুদ করার মতলবে সক্ষাৎকার নিতে গেলে যে কোনো ব্যক্তিই ক্ষুব্ধ হবেন। তবে, রাজনীতিকদেরও এটা বুঝতে হবে যে, সাংবাদিক যা জানতে চান তার চাইতে বেশি সমস্যা নিহিত থাকে তাদের অদম্য আগ্রহের সঙ্গে ফস্ করে কিছু বলে ফেলার মধ্যে, যার জন্য তাদের পরে পস্তাতে হয়। আমি ‘মজাদার’ শব্দটা উপভোগ করি। তীক্ষ্ণ, আমোদজনক, রুচিকর অথচ হুল ফোটাতে দক্ষ, এমন প্রশ্নই তো মজাদার। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সেরা প্রশ্ন তো সেটাই, যা আমোদজনক। তাহলে সেরা উত্তর কী? শীতল মেজাজ। এ মেজাজ যিনি হারালেন, সাক্ষাৎকারেও তিনি হেরে গেলেন।

 
বিডি-প্রতিদিন/ ২২ অক্টোবর, ২০১৫/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর