২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ১১:১৩

প্রেমে পড়তে লজ্জা পেত বদনামের ভয়ে

সমরেশ মজুমদার

প্রেমে পড়তে লজ্জা পেত বদনামের ভয়ে

‘আমার ছেলে প্রতিটি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। স্কুল-কলেজে যখন পড়ত, তখন সকাল-সন্ধ্যে খুব সিরিয়াস ছিল পড়াশোনায়। যে বয়সে ছেলেরা সিগারেটে টান দিতে শুরু করে, সেই বয়সে সে বলত, সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়। এমন ভয়ানক তথ্য জেনেশুনে লোকে কেন যে ধূমপান করে! ওর কোনো  আড্ডা মারার বন্ধু ছিল না। দু-একজন সহপাঠীর সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখত, যারা পড়াশোনা ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলতে জানত না। সিনেমা দেখার সময় পেত না, যদি ইচ্ছে হতো অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ড টিভিতে দেখত কিছুক্ষণ। আমরা একটা ব্যাপারে খুব খুশি ছিলাম। মেয়েদের ব্যাপারে আমার ছেলের কোনো আগ্রহ ছিল না। ওর মা অনেক যাচাই করে নিশ্চিত ছিলেন, ওর কোনো বান্ধবী নেই। এমনকি ও পাস-টাস করে যখন মোটা মাইনের চাকরি পেল তখনো ওর অফিসের কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয়নি। এখন সকালে অফিস থেকে গাড়ি আসে, রাত ৮টায় ফেরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বিদেশে ভালো চাকরির অফার পেয়েছিল কিন্তু আমরা একা থাকব বলে যেতে চায়নি। আমাদের উচিত ওকে সংসারী করে দেওয়া। চিরকাল তো আমরা থাকব না। কথাটা প্রচার করতেই এত প্রস্তাব আসছে যে কাকে ফেলে কাকে রাখব বুঝতে পারছি না।’ উপরে যার বক্তব্য রাখলাম, তিনি গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বক্তব্যটি চিঠিতে আমাকে জানিয়েছিলেন, উনিশশো পঁচাশি সালে, যখন তার পুত্রের বয়স আঠাশ। তার স্ত্রী এখন প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি।

দ্বিতীয় চিঠিটি এক মহিলার, লিখেছেন তার বান্ধবীকে, প্রায় ওই সময়েই। ‘আমার মেয়ের কথা তোমাকে আর কি বলব! ও যে ডানাকাটা সুন্দরী তা অতি বড় শত্রুও না বলে পারবে না। পড়াশোনায় খুব ভালো, চমৎকার গানের গলা। কথা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত ও কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। যদি কেউ ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে তা হলে সময় নষ্ট না করে আমাকে বলে দিয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। বেথুন থেকে পাস করার পর ওর বাবা ওকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করেছিল। কিন্তু তিন দিন ক্লাসে যাওয়ার পর ও বেঁকে বসল। এতদিন শুধু মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়েছে, ইউনিভার্সিটিতে যেসব ছেলে পড়তে আসে তাদের কেউ কেউ ওকে কফি হাউসে নিয়ে যেতে চাইল, কেউ সিনেমা দেখাতে চাইল। ওই তিন দিনে ও এত কাহিল হয়ে পড়ল যে আর ক্লাসে যেতে চাইল না। আমিও ভাবলাম, যতই পড়াশোনা করুক ও তো চাকরি করতে যাবে না। তাই একটি ভালো পরিবারের ভদ্র সন্তানের সঙ্গে সংসার করুক, শান্তিতে থাকুক। এখন আমি সেই পাত্রের সন্ধান করছি। যেমন তেমন পরিবারের ছেলের সঙ্গে তো ওর বিয়ে দিতে পারি না। তোমার উপর আমার ভরসা আছে। একটু দেখো।’ অর্থাৎ আজ থেকে ৩০ বছর আগে যেসব ছেলেমেয়ের জন্য তাদের বাবা-মা গর্ব করতেন, সোনার ছেলেমেয়ে বলে প্রতিবেশীরা ঈর্ষা করতেন, তারা আজ এই দুটো বক্তব্য শুনলে অস্বস্তিবোধ করবেন। বন্ধুবান্ধবহীন, ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা অথবা চাকরিতে ডুবে থাকা ছেলে মানেই তার কোনো সমস্যা আছে, সে স্বাভাবিক নয়। একইভাবে কোনো মেয়েই আজ স্বাবলম্বী না হয়ে সংসার করতে চায় না। অন্তত যারা পড়াশোনায় ভালো তারা তো নয়ই। বিয়ে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, এই ভাবনা তারা ছুড়ে ফেলেছে। ক’দিন আগে টিভিতে একটি নতুন ধারাবাহিকে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছিল। যেখানে একটি অল্পবয়সী মেয়ে কনের সাজে সেজে বলছে, ‘মেয়েদের একটাই জীবন, একটাই বিয়ে।’ নাতনি দ্রুত রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করতেই বাংলা সিরিয়ালের নেশায় ডুবে থাকা ঠাকুমা ক্ষিপ্ত হলেন। নাতনি তাকে শান্ত গলায় বলল, ‘এটা দু’হাজার পনেরো খ্রিস্টাব্দ। উনিশ শতক নয়। এসব ঘটনা হয়তো তোমাদের আমলে স্বাভাবিক ছিল, এখন হাস্যকর বললে কম বলা হবে।’ মেয়েটির কথা সত্যি হলেও মহিলারা ওইসব গপ্পো টিভিতে দেখতে পছন্দ করেন, যেমন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ধারাবাহিক তাদের আকর্ষণ করে। সময় বদলে গেছে। দিনের পর দিন মিশেও যখন ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বুঝতে পারছে না, তখন বাবা-মা পছন্দ করে যে পাত্রকে নির্বাচন করছেন তার সঙ্গে জীবনের বোঝাবুঝি কতটা সম্ভব? আর বাবা-মা পছন্দ করবেন কিভাবে? আগে বংশ দেখা হতো, আত্মীয়স্বজন এবং পাড়ার লোকের কাছে খবর নেওয়া যেত। প্রয়োজনে পাত্রের অফিসে কোনো না কোনো সূত্র পাওয়া অসম্ভব ছিল না। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে বহুকাল আগে। বংশমর্যাদা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। বেশিরভাগ তথাকথিত ভালো ছেলেরা নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে তারা আত্মীয়স্বজনের খবর রাখে না, পাড়ার কারও সঙ্গে মেশে না। অতএব খবর নেওয়ার পথ বন্ধ। অফিসে খবর নিতে গেলে বিয়ে ভেঙে যাবে, কারণ এই গোয়েন্দাগিরির খবর পাত্রের কানে যাবেই। তবু বাবা-মাকে দেখে পাত্র নির্বাচন করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। কোনো মেয়ের উড়ো ফোনে, যে দাবি করেছে তার সঙ্গে পাত্রের শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়া এখন আর অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। ৩০ বছর আগে যা কেউ কল্পনাও করতে পারত না, এখন সেটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। মনে আছে, কোনো মেয়ে যদি একবার প্রেমে পড়ার পরে কোনো কারণে সেই প্রেম উধাও হয়ে যায় তাহলে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়তে লজ্জা পেত বদনামের ভয়ে। আমাদের তরুণ বয়সে এটাই নিয়ম ছিল। এখন সম্বন্ধ করে অথবা পছন্দের বিয়ে যদি টালমাটাল হয় তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসতে কেউ দ্বিধা করছে না। যে ছেলে কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে তাকায়নি, যে মেয়ে কোনো ছেলের ছায়া মাড়ায়নি, তাদের এখন ‘অস্বাভাবিক’ ভাবা হচ্ছে। বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে মেয়ে দিব্যি চাকরি করছে, আবার বিয়ের কথা বললে বলছে, ‘ম্যাগো’। ওর ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে মাথা খারাপ মা-বাবার। ৩২ বছর বয়সে মেয়ে প্রেমে পড়ল এক ডিভোর্সি ছেলের।

গোপনে খবর নিলেন বাবা-মা, কেন ছেলের ডিভোর্স হয়েছে? জানতে পেরে শিউরে উঠলেন, ‘ছেলের যৌন ক্ষমতা নেই বলেই আগের বিয়ে ভেঙেছে।’ মেয়েকে সে কথা বলতেই সে হেসে বলছে, ‘জানি তো, তাই ওকে ভালো বাসলাম। বাকি জীবন একসঙ্গে থাকতে পারব। আমারও তো ওসব একদম ভাল্লাগে না।’

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৯ অক্টোবর, ২০১৫/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর