২ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:০৭
দিল্লির চিঠি

বিরক্তির পরিবেশনা টিভির মারাত্মক পাপ

এম জে আকবর

বিরক্তির পরিবেশনা টিভির মারাত্মক পাপ

কয়েক শতাব্দী আগে লন্ডন ও ওয়াশিংটনে আধুনিক গণতন্ত্র শিশুসুলভ হাঁটিহাঁটি পা-পা করছিল, তখন থেকেই সমানতালে ক্ষমতার খেলায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে যার সঙ্গে লড়তে হয়েছে তার নাম ‘মিডিয়া’। মিডিয়া অনেক কিছু হতে পারে, প্রায়শ হয়ও। সে হয় খুঁতখুঁতে, বস্তুনিষ্ঠ, যা করতে চায় করতে না পেরে ফুঁসতে থাকে, দারুণ ফলপ্রদ কিংবা কলঙ্কজনক পক্ষাবলম্বনকারী হয় সে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কখনই তার এক নম্বর কাজ নয়। ষড়যন্ত্রের বেলায় সাংবাদিকরা মরিয়া হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে না। মিডিয়া মালিকরা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটাতে পছন্দ করেন। তবে জনমত গড়ে তোলার শক্তি আহরণকেই তারা বেশি গুরুত্ব দেন। তাদের মূল লড়াইটা চলে একের সঙ্গে অন্যের। চক্রান্ত আঁটার মতলবে তারা গোপনে কোনো কামরায় মিলিত হচ্ছেন মনে হলে, সাবধান! এতে অবশ্য একটা প্রশ্ন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশ্নটি হচ্ছে, বিহার বিধানসভা নির্বাচনের তীব্র প্রচারাভিযানে গিয়ে রাহুল গান্ধী জনসভায় যে বক্তৃতা করলেন, তার সংবাদ পরিবেশনের সময় কী দেখানো হলো? দেখা গেল, প্রতিটি টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল শুধু রাহুলের মুখটাই দেখাচ্ছে, জনতা দেখাচ্ছে না। জনতা দেখাতে তাদের অনিচ্ছা কেন? কেন টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো রাহুল গান্ধীর মুখমণ্ডলে স্থির হয়ে থাকে আর তার মুখনিঃসৃত শব্দাবলি প্রচার করে? ভান করে যেন ক্যামেরার নড়নচড়ন অসম্ভব ব্যাপার। কেন?  

জবাব একটা হতে পারে। জনতা না থাকায় টেলিভিশন জনতা দেখায় না। তবে গরহাজির থাকাটাও একটা ব্যাপার। প্রশিক্ষণরত প্রতিটি সাংবাদিক এ কাজটা করেন। ‘বেচারা!’ উচ্চারণপূর্বক করুণ। প্রকাশ করবার মতো এটা? মাঝবয়সী কংগ্রেস নেতা কোনো না কোনোদিন অনুকূল আচরণ পাবেন, এমন আশার মিশ্রণ ছাড়াই কী ওই করুণা? করুণা সাংবাদিকতাকে বেশি এগিয়ে নিতে পারে না বটে, তবে আশা তত্ত্বের জন্য কিছু বলা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেই সহজ হয় টেলিভিশন। অসঙ্গত শ্রীহীন অনুষ্ঠান বিরক্তিকর এবং বিরক্তিকর পরিবেশনা টেলিভিশনের মারাত্মক পাপ। রাহুল গান্ধীর টেলিভিশনের প্রয়োজন হতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি রাহুলকে প্রয়োজন হবে টেলিভিশনের। চোখা-চোখা বাক্য সজ্জিত, নিজেকে হামবড়া প্রমাণের জন্য প্রস্তুত, সব সময় ধরমার ভঙ্গির কারণে লালুপ্রসাদ যাদবের মূল্য (টিভির কাছে) রাহুল গান্ধীর চাইতে অনেক বেশি। কিন্তু লালু তো কোনো বিকল্প নন। তিনি প্রাদেশিক আঞ্চলিক নেতা। কংগ্রেসকে সারা দেশে (টেলিভিশনে) মুছে দিতে গিয়ে যে শূন্য তৈরি হচ্ছে তা তো প্রাদেশিক নেতা দিয়ে পূরণ হওয়া নয়। আমার প্রিয় সাময়িক পত্রিকাগুলোর অন্যতম ‘স্পেকটেটর’। প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। পত্রিকাটির মন্তব্য প্রায়শই হজম করা কঠিন, কিন্তু স্টাইল ও যুক্তিগুলো মুগ্ধকর সূ²। ধ্রুপদী দৃষ্টিতে বলা চলে যে, পত্রিকাটি হচ্ছে লোকাচার সম্পাদকীয় প্রকাশনা যেখানে থাকে সপ্তাহ ধরে পুঞ্জীভূত রসালো তথ্যাবলি। অলস আড্ডায় সময়কাটানো ব্যক্তিদের কাছে এসব তথ্যের কদর নেই। এ পত্রিকা কত কিছু শেখায়। দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ব্রিটিশ মুখে কুলুপ এঁটে রাখার জন্য বিখ্যাত। কেন তারা ঠোঁট ফাঁক করা বন্ধ করে? ‘স্পেকটেটর’ বলছে, সাম্রাজ্য যত প্রসারিত হয় ততই তারা ভয়জনিত কান্না চেপে রাখার জন্য উপরের ঠোঁটখানা চেপে রাখে। কারণ তাদের কাছে মনে হতো, নেটিভদের কাছে চোখের পানি আড়াল করে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভয়টা ছিল বাদামি রঙের কুলিরা যদি টের পেয়ে যায় যে ‘বড় সাহবে’ ও তার মতোই মানুষ তাহলে তারা ব্রিটিশ রাজের পতন ঘটিয়ে ফেলবে। দৃশ্যত ব্রিটিশরা আবার কাঁদতে শুরু করে ১৯৫০-এর দশকে-ভারত হারানোর পর। আমি মনে করি তাদের এই কান্না খুবই যৌক্তিক যদিও তারা ইতিহাসের শ্রেণি কক্ষের অভ্যন্তরের চাইতে ছায়া ছবিতেই বেশি কান্নাকাটি করেছে। ‘স্পেকটেটর’-এর ১০ অক্টোবর সংখ্যায় দেখি তারা ইংরেজি ভাষায় একটা নতুন বাকবিধি সংযোজন করেছে। কথাটার উদ্ভাবক হলেন জেমস বার্থোলমিড নামের অনিয়মিত এক কলামিস্ট। কথাটা ‘গুণের ইশারা’। সত্যিকার অর্থে সদুদ্দেশ্যে কোনো কিছু না করেই যারা নিজেকে উচ্চস্তরের মহৎ ব্যক্তি বলে জাহির করে তাদের চেনাতে ব্যবহার্য ‘গুণের ইশারা।’ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের তহবিলে টাকা-পয়সা না দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের ফিতা ধারণ করে এরা। আগের কালে এরা ‘আওয়াজি তালেবর কাজে লবডংকা’ নামে পরিচিত ছিল। আমার ধারণা এদের নতুন নাম দেওয়াটা তাৎপর্যময়। দিল্লির বিভিন্ন বলয়ে ‘গুণের ইশারা’ কথা এখনো চালু হয়নি। এটা আশ্চর্যজনক। আমাদের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান রাজধানী এরকম প্রাণীদের স্বর্গ যারা খুবই কমদামে উচ্চখ্যাতি অর্জনের সম্ভাবনা উপভোগ করছে। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক এলিটরা ‘গুণের ইশারা’কে বিশেষ শিল্পে উন্নীত করতে পারেন। গুণের ইশারা করবার জন্য দীর্ঘ সাধনা দরকার?  

আমার মতে ব্যাপারটি ঐচ্ছিক করে দেওয়া দরকার। যা বাধ্যতামূলক তা খুব একটা গণতান্ত্রিক হয় না এবং আমরা তো প্রায়শই গুণের ইশারা করছি- বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে নায়কদের কি নিরীহ হতে হয়? হায়দরাবাদে আমরা তেমন একজনকে পেলাম। তিনি কে, ভেংকট নারায়ণ। ২৮ বছর বয়সী এই লোকটা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাকে ৫ লাখ রুপি ঋণ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে সরকারি একটি ব্যাংককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন। ব্যাংকটার নাম করছি না। এই ব্যাংক অকেজো সম্পদ বন্ধক রেখে প্রতারক ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি রুপি ‘ঋণ’ দিয়ে বসে আছে অথচ নারায়ণের ঋণ আবেদনকে বৈধ না অবৈধ বলবে, ভেবে কিনারা পাচ্ছে না। নারায়ণ তো দান প্রার্থনা করেনি। নির্বাচনী সংস্কার বিষয়ে যখনই আলোচনা হয়, জ্ঞানগুণীরা তখন বাকবাকুম করতে থাকেন, শেষতক স্থিতাবস্থায় ফিরে যান। কী করতে হবে, তা কেন তারা এই যুবকটিকে বলছেন না? কাহিনীর শেষ না হতে পারে, এটা হবে শুরু।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর