২ নভেম্বর, ২০১৫ ১৩:০০
বিশেষ কলাম

কেমন সংসদ দেখতে চায় টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেমন সংসদ দেখতে চায় টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সংক্ষেপে আমরা যাকে টিআইবি নামে চিনি। অযাচিত জ্ঞানদানের প্রতিষ্ঠান। তোফায়েল সাহেব বলেছেন, এটা নাকি বিএনপির সংগঠন। হতেই পারে। একই সুরে যখন কথা। আমি এটাকে কারও অঙ্গও বলছি না প্রত্যঙ্গও বলছি না। আমার প্রশ্ন, এদের উদ্দেশ্যটাইবা কী আর চাচ্ছেইবা কী? সংসদের কার্যক্রম ওয়াচ করতে চায় করুক। সংসদ জনগণের প্রতিষ্ঠান। জনগণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। যে কেউ এর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু সেই জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কটাক্ষ কিংবা অশালীন উক্তি করার অধিকার টিআইবিকে কে দিয়েছে? টিআইবি কোথা থেকে জন্মাল, কেন জন্মাল কিংবা দেশ ও জাতির জন্য কী তাদের প্রয়োজনীয়তা- আমার কাছে তো বোধগম্য নয়। এদের অর্থের উৎস কোথায়, কাদের এজেন্ডা এরা বাস্তবায়ন করে, তাও জানার বিষয়। আইন-নিয়ম-নীতি এবং সাংবিধানিক আওতায় বর্তমান সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ বলার অধিকার এবং সাহস টিআইবি নামের গজিয়ে ওঠা জ্ঞানদানের এই ‘শুদ্ধসংস্থার’ কী করে হলো তাও আমাদের জানতে হবে। আমরা সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি। সংসদে আমাদের কার্যকলাপ নিয়ে আমরা জবাবদিহিতায় বাধ্য। আমাদের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে সমালোচনা-পর্যালোচনা হোক তা আমরাও চাই। তাই বলে কোনো আগাছা-পরগাছা একটি স্বাধীন দেশের সাংবিধানিক সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ বলবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই অশালীন উক্তি করে টিআইবি পবিত্র সংসদকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। এর জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় সরকারকে এই টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অবমাননা আমরা জনপ্রতিনিধিরা মেনে নিতে পারি না।    

আমি শিরোনামেই প্রশ্ন রেখেছি, টিআইবি কেমন সংসদ দেখতে চায়? টিআইবি বর্তমান সংসদের বিরোধী দলকে ‘কথিত বিরোধী দল’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডকে মন্তব্য করেছে ‘লেজুড়বৃত্তি’ বলে। আমাদের দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়েছে ১৯৯১ সাল থেকে। সেই সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত বিরোধী দলের কার্যকলাপের ধরন ও চরিত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এবং ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। পঞ্চম থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত বিরোধী দল মানে কথায় কথায় অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট, সংসদ বর্জন-বয়কট এবং সংসদের মধ্যে ফাইল ছোড়া, ক্যামেরা ভাঙা, মাইক্রোফোন ছিঁড়ে ফেলা, পরস্পরের প্রতি গালিগালাজ করা, চুলোচুলি-মারামারির উপক্রম হওয়া, নেতা-নেত্রীদের চরিত্রহনন করা- এমনকি প্রয়াত জাতীয় নেতাদের প্রতি অশালীন উক্তি করা। সংসদে যখন বিরোধী দল উপস্থিত থেকেছে তখন সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে এমন ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছে যার সরাসরি সম্প্রচার কেউ ছেলে-মেয়ে সঙ্গে নিয়ে শুনতে বা দেখতে পারতেন না। ছিঃ ছিঃ বলে মুখে কাপড় দিতে হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পঞ্চম থেকে নবম পর্যন্ত বিরোধী দল কতদিন সংসদে থেকেছে তার একটি পরিসংখ্যান এই আলোচনার মধ্যেই তুলে ধরব। তার আগে বিরোধী দলের কার্যকলাপের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। এই আলোচনাটি লেখার সময় দশম সংসদে, যেখানে আমরা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আছি সেখানে এ পর্যন্ত ১৫৬ দিন সংসদের অধিবেশন হয়েছে। এখানে তফাৎটা এই যে, পঞ্চম থেকে নবম পর্যন্ত সংসদে বিরোধী দল যে চর্চা করেছে তা আমরা করিনি। তার জন্য টিআইবির দৃষ্টিতে আমরা ‘কথিত বিরোধী দল’ হয়ে গেছি। তাহলে টিআইবি’কে তুষ্ট করতে আমাদের কি করতে হবে? সংসদ বর্জন করতে হবে, গালিগালাজ করতে হবে, ভাঙচুর করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি- যা অতীতে ঘটেছে, তাই তো? কিন্তু তা যে আমরা পারব না। আমরা নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যে ভূমিকা পালন করতে হয় তা-ই করে যাব। যারা আমাদের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করতে চায়, যারা স্থিতিশীলতাকে নস্যাৎ করতে চায়, সেই সব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে তো আমরা পা দিতে যাব না। আমি একটি কথা নির্দ্বিধায় এবং স্পষ্ট করে বলতে চাই, দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন হলেও ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথার্থভাবে কার্যকর হয়নি। এই সময় কী ঘটেছে তা আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে লেখা আছে। দশম সংসদের নির্বাচন কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু তা আইন ও সংবিধানের পরিপন্থী ছিল না। কিন্তু ’৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে সংসদীয় শাসনের নামে পালাবদল করে একেকজনের শাসন চালু রয়েছে কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা কখনো হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিহার্য। আমাদের সংসদের ইতিহাস বলে, এই সময়ের মধ্যে কোনো বিরোধী দল বা বিরোধীদলীয় নেতা সংসদে কখনোই কার্যকর ভূমিকা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। অথচ এরাই পালাবদল করে ক্ষমতায় এসেছেন। আমি কৌতূহলবশত সংসদে সংসদ নেতা এবং বিরোধী নেতার অধিবেশনে উপস্থিতির একটা পরিসংখ্যান নিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো ’৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চম সংসদে সংসদ নেতা অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পুরো মেয়াদে একদিনও সংসদ অধিবেশনের হাজিরা খাতায় অর্থাৎ রেজিস্টার বুকে স্বাক্ষর করেননি। পঞ্চাশ বছর বা একশ বছর পর যদি কেউ পঞ্চম সংসদের ইতিহাস দেখতে চায়, তাহলে সে দেখতে পাবে এই সংসদে কোনো সংসদ নেতা ছিলেন না। যেহেতু উপস্থিতির খাতায় তার কোনো স্বাক্ষর নেই। তিনি হয়তো গৃহবধূ থেকে নেত্রী হয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন, সব নিয়ম-কানুন তার হয়তো জানা ছিল না কিন্তু তার দলে কি একজন লোকও ছিলেন না, যিনি সাহস করে প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন যে, অধিবেশনে যোগ দিতে হলে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করতে হয়। অথচ উপস্থিতি ভাতা তিনি ঠিকই গ্রহণ করেছেন।  

আবার এই সংসদই সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। আমি যে বলেছি-’৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর হয়নি, তার স্বপক্ষে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরতে চাই। পঞ্চম সংসদের মোট কার্যদিবস ছিল ৪০০ দিন। এই ৪০০ দিনের কার্যদিবসে সংসদ নেতা বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিতি খাতায় একদিনও স্বাক্ষর করেননি। বিরোধী নেতা শেখ হাসিনা ৪০০ দিনের মধ্যে ১৩৫ দিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তারপর টানা দুই বছর ছিল বিরোধী সংসদ সদস্যশূন্য সংসদ। কারণ, সংসদ নির্বাচনে দুর্নীতি বা কারচুপির মডেল হিসেবে খ্যাত ‘মাগুরা উপনির্বাচনের’ পর বিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হওয়ার একপর্যায়ে সব বিরোধী দল এমনকি যে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল তারাও একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আমি তখন কারাগারে। সেখানে বসেই আমার আইনজীবীর মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলাম। দেশের ৭০ ভাগ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করার পরও গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তখনকার সংখ্যালঘু সরকার পদত্যাগ করেনি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভোট পেয়েছিল মাত্র ৩০.৮১ শতাংশ। টিআইবি সেসব অতীত ঘেঁটে দেখেনি। আমি বা আমার দল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির সমর্থক বা উত্তরাধিকারী হলেও সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে ফেরার পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, সব দল যখন চাইছে জনগণও এটা সমর্থন করতে পারে, তাই সংসদে সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শাসন পদ্ধতির পরিবর্তনে হয়তো দেশ ও জনগণের কল্যাণ হবে। কিন্তু কল্যাণ তো দূরের কথা, গণতন্ত্রের ন্যূনতম চর্চাটুকুও হলো না। যে সংসদে আমার দলের ভোটে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে, পুরো মেয়াদে সেই সংসদে একটিবারের মতো আমাকে বসতে দেওয়া হয়নি। এটাই ছিল তৎকালীন সরকারের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, চলমান গণতন্ত্রে সেটাই চলেছে এবং চলছে। তবে ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যারা গণতন্ত্রকে প্রতিহিংসার কালিমা দিয়ে কলঙ্কিত করেছে তাদের পরবর্তী সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র একদিন। ষষ্ঠ সংসদ আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে, তবে একদিনের অধিবেশনের মধ্যদিয়ে একটি সংসদীয় সরকারের পতন ঘটে যায়। সুতরাং সংসদীয় গণতন্ত্র এখানেও ছিল অকার্যকর। এলো সপ্তম সংসদ। এই সংসদের মোট কার্যদিবস ছিল ৩৮২ দিন। বিরোধী নেতা পুরো মেয়াদে সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২৮ দিন। এরপর অষ্টম সংসদের মোট কার্যদিবস ৩৭৩ দিন। এখানে বিরোধী নেতা উপস্থিত ছিলেন ৪৫ দিন। তারপর নবম সংসদের কার্যদিবস ছিল ৪১৮ দিন। এখানে বিরোধী নেতা রেকর্ড সৃষ্টি করে মাত্র ১০ দিন উপস্থিত হয়েছেন। এই যদি হয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সংসদের অপরিহার্য অঙ্গ বিরোধী পক্ষের ভূমিকা, তাহলে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সফল হয় কীভাবে? এই পদ্ধতিতে বিরোধী দলকে বলা হয় ছায়া সরকার। কথায় বলে কায়া থাকলে তার ছায়া হয়। অশরীরী আত্মার ছায়া হয় না। তাই সংসদীয় সরকারকে কার্যকর করতে হলে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকতেই হবে। কিন্তু ’৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা গোটা জাতি দেখতে পায়নি। এসব নিয়ে টিআইবি কখনো মাথা ঘামিয়েছে বলে মনে পড়ে না। তাদের প্রতিবেদনে বর্তমান বিরোধী দলের জোরালো ভূমিকা না দেখার কথা উল্লেখ করেছে। জোরালো ভূমিকা বলতে গত পাঁচটি সংসদে যা দেখে এসেছি তাই কি এখন তাদের দেখতে হবে? বিরোধী নেতা যদি পাঁচ বছরের মধ্যে ১০ দিন মাত্র সংসদে উপস্থিত থাকেন, সেটাইকি বিরোধী দলের জোরালো ভূমিকা? পরিশেষে, টিআইবির প্রতিবেদন নিয়ে আরও কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হলো। দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে টিআইবির গাত্রদাহের হেতুটা কী? সুষ্ঠুভাবে একটি সংসদ চলছে, এটা কি তাদের সহ্য হয় না? বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আচরণ কি তাদের পছন্দ নয়? যুদ্ধাপরাধীরা গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে এই সংসদে আসতে পারে না, এটা কী তাদের অন্তর্জ্বালা? আশা করি, এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সংসদের আগামী অধিবেশনে খুঁজে পাব। লেখক : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর