২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ১১:০১

বিচারের রায় বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক

জিন্নাতুন নূর

বিচারের রায় বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক

যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং বিচার বিভাগ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। যে বিচারের রায় ২২ নভেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে কার্যকর হয়েছে তা পুরো জাতির জন্য একটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে অস্বীকার করছেন তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারবেন না। এই বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা মোটামুটি একটি নতুন পথচলার দিকনির্দেশনা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ড. এম এ হাসান গতকাল একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন। ড. হাসান বলেন, দুটি রায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারীর বিচার আর আরেকটি হচ্ছে একাত্তরে যারা পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে সেই বিচার। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারের রায় কার্যকর প্রসঙ্গে আমি বলব যে, যারা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি করেন বা করার স্বপ্ন দেখছেন তাদের জন্য এই রায় ছিল একটি বড় ধরনের আঘাত। যারা পাকিস্তানমুখী হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের মদদ নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চান তাদের মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি হবে অত্যন্ত দুরূহ ও অকল্পনীয় ব্যাপার। এই গবেষক বলেন, এখন থেকে যারাই বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন তাদের দুটো জায়গায় একমতে পৌঁছাতে হবে। প্রথমত শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক রাজনীতি করতে হবে, দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন মনে করে সেই আদর্শ নিজের মধ্যে লালন করে রাজনীতির চর্চা করতে হবে। মুজাহিদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। সেটি হলো, যারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করতেন অর্থাৎ জামায়াতপন্থি যে রাজনীতি সেটি জনগণ আর গ্রহণ করবে না। আমি মনে করি, জামায়াত দল হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর যদি আবার নতুন করে আবিভর্‚ত হয় তারপরও সাধারণ মানুষ জামায়াতের নষ্ট দর্শনের কারণে এ দলটিকে আর গ্রহণ করবে না। আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি করতে হলে জামায়াতকে ভিন্ন নীতি নিয়ে করতে হবে। তারা ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যে রাজনীতি এতদিন ধরে করে আসছিল তা বাংলাদেশে আর চলবে না। এ ছাড়া জামায়াতের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে একই ধারণার অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন মুসলিম লীগের কিছুটা একই রকম চিন্তাভাবনা ছিল, তাদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তার একটি নিদর্শন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আমার মতে, এই ঘরানার রাজনীতিকে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসন করার সময় এখনই। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক আরও বলেন, আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, বর্তমানে যারা ইসলামের নামে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা বিভিন্ন ধ্বংসাÍক কাজ করার চেষ্টা করছে। তারা সেই ধরনের রাজনীতি বিকশিত করার চেষ্টাও চালাবে। আর পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম দেশ এই দলগুলোকে পরোক্ষভাবে মদদ দেয়। এই আরব দেশগুলোর গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থা যারা এই দলগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করে তারাও বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চালাবে। যেহেতু তাদের একটি পথ বন্ধ হয়ে গেছে এ জন্য অন্য পথে যাওয়ার চেষ্টা চালাবে। এ জন্য সরকার ও জনগণকে একত্রে এ ধরনের মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণকে একত্রে মেলবন্ধন গড়ে তুলে পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি করতে হবে।

ড. হাসান বলেন, সরকারের মধ্যে কিছু উচ্চ পর‌্যায়ের লোক আছে যারা ব্যক্তিগতভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘করপোরেট ফিনান্সিং’ বলে একটা বিষয় আছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ইসলামিক দলসহ পাকিস্তানের প্রভাব আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যে, বিভিন্ন আরব দেশের যে প্রতিনিধিরা এই দেশে ইফতারসহ রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তাদের মধ্যে অনেককেই ‘আওলিয়া’ ‘দরবেশ’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। আর এই মানুষগুলো কঠোরভাবে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে। ফলে দেশের কিছু উচ্চ পদস্থ লোক বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে সন্দেহ করেছিলেন যে, সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির রায় হয়তো কার্যকর হবে না। তবে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে, শুধু একজন ব্যক্তির দৃঢ়তার কারণেই এ রায় কার্যকর সম্ভব হয়েছে। আর তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি বলছি না যে, শেখ হাসিনা বিচারকাজে হস্তক্ষেপ করছেন কিংবা তিনি কাউকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বলেছেন। তবে রাষ্ট্রের কাছে যখন বাইরের দেশগুলো থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ও সমঝোতা আসছিল তখন শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে সমঝোতার পথটি এড়িয়ে গেছেন। আমার মনে পড়ে ২০০২ সালে শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দেখা করতে চাইলেন। সেটা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ঝড় উঠেছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে তিনি তার দৃঢ়তা বরাবরই ধরে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, সরকার দৃঢ় মনোভাব নিয়েই রায় কার্যকর করেছে। তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে যে কথাটা বলানো হয়েছে আমার ধারণা কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছে। আমি নিজেও তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। অ্যামনেস্টি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে কাজ করছে। সে কাজগুলো দেখার সুযোগও হয়েছিল। কাজেই তারা যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কাজ করে এবং এর পক্ষেই দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় মনে হচ্ছে এর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার রয়েছে। এই গবেষক বলেন, বাংলাদেশের জনগণ, সরকার, আদালত অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যে কাজটি করেছে তা আমাদের জন্য একটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। তারপরও আমাদের পাকিস্তানের প্রতিহিংসাপরায়ণতার কথা মনে রাখতে হবে। এগুলো মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যতে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপির বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু থেকে দলটি কোনো না কোনোভাবে সরে আসার চেষ্টা করবে। কারণ তাদের ভিতরে এ নিয়ে চাপ রয়েছে। তারা এটি করবে বলে আশা করছি। আর যদি তা না করে তবে বলতে হবে দলটি অতি বড় ‘নির্বোধ’-এর দল। এ জন্য অচিরেই তারা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর