৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৪:০৩

প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

প্রার্থনার স্বাদ

‘মালিকি ইয়াউমিদ্দিন’ অর্থাৎ বিচার দিনের স্বামী নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে বৈকি। মালিক, প্রভু ও সার্বভৌমের ভূমিকায়। সৃষ্টির সময়ই তা নির্ধারিত। একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নির্ধারিত যিনি সত্যিকার রাজা, তার জন্যই। অন্য কেউ সুপারিশের জন্যে একটি বাক্যও উচ্চারণ করার অনুমতি পায় না। মালিক কথাটির আবৃত্তি দুই ভাবে, একটি মাু লিকি, যা এসেছে অধিকার থেকে। আরেকটি মালিকি অর্থাৎ রাজার সার্বভৌম অধিকার থেকে। দুটি অর্থই আল্লাহর একক ও সম্পূর্ণ আধিপত্যের নির্দেশক। পড়া যাক : ‘সূর্য যখন হয়ে পড়বে নিস্তেজ ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন, আকাশের তারাগুলো খসে পড়বে... পাহাড়গুলো চলতে থাকবে, সমুদ্র আগুনের মতো গর্জে উঠবে... বন্য পশুরা একত্রিত হবে... দেহে যোগ করা হবে আত্মা...’ [৮১:১-৬] ‘ভাই পালাবে ভাইয়ের কাছ থেকে, মাতা-পিতা, পত্নী ও সন্তান হতে’ [৮০:৩৪-৩৬] ‘স্তন্যদাত্রী ভুলে যাবে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু, গর্ভবতী ফেলে দেবে নিজ গর্ভ, মানুষকে দেখা যাবে নেশাগ্রস্তের মতো, যদিও নেশা করেনি তারা। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন’ [২২:২] ‘সেদিন আকাশমণ্ডলীকে গুটিয়ে ফেলব, যেভাবে গুটান হয় লিখিত দফতর [২১:১০৪]। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তার হাতের মুঠিতে’ [৩৯:৬৭]। ‘শিঙ্গায় যখন ফুঁ দেওয়া হবে, যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সকলে মূর্ছিত হয়ে পড়বে... [৩৯:৬৮]। কে বাকি রয়ে গেল? শিঙ্গায় ফুঁ দিচ্ছেন যে ফেরেশতা, তিনি জিজ্ঞেস করবেন। তখন আল্লাহ তার আত্মা গ্রহণ করলেন। কে বাকি রয়ে গেল? কেউ নয় এবং আমাদের প্রভু বলবেন : ‘আজ কর্তৃত্ব কার’? কোনো উত্তর নেই। ‘আজ কর্তৃত্ব কার’? সম্পূর্ণ নিশ্চুপ চারদিক। এবার আল্লাহ নিজে থেকেই জানাবেন তার নিজ প্রশ্নের উত্তর : ‘আল্লাহই এক এবং পরাক্রমশীল যার ধ্বংসলীলা’ [ওয়াহেদুল কাহ্হার]’ [৪০:১৬] ‘শিঙ্গায় পুনরায় ফুঁ দেওয়া হলে, ওরা দাঁড়িয়ে যাবে, তাকাবে ফ্যাল ফ্যাল করে’ [৩৯:৬৮] ‘বিশ্ব হবে উদ্ভাসিত রবের জ্যোতিতে’ [৩৯:৬৯] ‘রব সেদিন নিজকে প্রকাশ করবেন। সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতারাও। জাহান্নামকে নিয়ে আসা হবে সামনে’ [৮৯:২২-২৩]। আয়াতগুলো বারংবার পাঠ চোখের সামনে সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়। একদিন আসবে যখন সূর্য কাছে এসে পড়বে। পঞ্চাশ হাজার বছরের দূরত্বে। এটি হবে বিভীষিকাময়। এটি পড়ার সময় হৃদয় প্রকম্পিত হতেই হবে যদি আমরা চিন্তা করি। উচ্চারণ করার সময়, এর গুরুত্ব হৃদয়ে নেই না, আউড়ে যাই মাত্র। এটি অমনোযোগী পাঠ, মুখস্থ করার কারণে। প্রভুর কাছে মুখস্থের কি দাম, দাম হলো হৃদয় থেকে তা উৎসরণের। ‘তবে কি ওরা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? ওদের অন্তর কি তালা দিয়ে বন্ধ’ [৪৭:২৪] বলা হয়ে থাকে, যারা নিবিষ্ট চিত্ত, প্রার্থনায় পূর্ণভাবে মশগুল, যেন পানির মাছ। মন দিতে পারেনি যারা, খাঁচায় বদ্ধ পাখি। মশগুল অর্থাৎ পাগলের মতো।

তা হলে সেই ভয়ঙ্কর দিন থেকে কি আমাদের দেবে মুক্তি? উত্তর আছে পরের চরণে, যা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুরা ‘আল-ফাতিহা’-র চুম্বক। এত বার পড়ি অথচ মনে রেখাপাত করে না কেন? আওড়ান বুলি হৃদয়ের অন্তরে প্রবেশ পথ খুঁজে পায় না। অথচ এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। ‘ইয়াকানাআ বুদু ওয়া ইয়াকানাআস্তাইন’ [একমাত্র তোমাকেই আমরা এবাদত করি এবং তোমার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন] প্রতি নবী তাদের ফেলে যাওয়া মানুষদের কাছে এই একটি বাণী নিয়ে এসেছিলেন, যা আমরা ভুলে বসে আছি। ‘আমি তো তোমাদের জন্যে এক মর্মন্তুদ দিনের শাস্তি আশঙ্কা করি, যেন তোমরা আল্লাহ ছাড়া অপর কারও এবাদত না কর’ [১১:২৬]। জীবনের আসল উদ্দেশ্য ভুলে বসে আছি, এবাদতের উদ্দেশ্যও। কেন আমাদের সৃষ্টি তা বার বার উপলব্ধি করতে গিয়েও ভুলে বসি সাংসারিক পারিপার্শ্বিকতার চাপে। কীভাবে আমরা জীবনের আসল উদ্দেশ্যটা আবার আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারি? একমাত্র আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ছাড়া। এবাদতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো হৃদয়ের সম্পূর্ণ নুয়ে পড়া। তা কি আমরা করি? আমরা যে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সারাটি দিন ব্যয় করছি, তা কি আমরা বুঝি? পাগলের মতো হতে হবে। পাগলামি করছি অন্য দিক দিয়ে। সারাদিন বয়ে নিয়ে চলেছি কর্মের গুরুভার, যা কমই কাজে আসছে। বরং মনটাকে হালকা করে দি। হে প্রভু, মসজিদে ছুটে এসেছি। কে দেখল, না দেখল তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছি। জীবনের নিবিষ্টতা তোমার উপলব্ধি, তোমাকে আমার সর্ব অন্তকরণ দিয়ে আহুতি দেব, আর কিছু নয়। আর কিছু চাই না। কোনো কিছু আমার অভীষ্ট নয়, তুমি ছাড়া। যখন আমাকে কেউ দোষারোপ করে তোমার প্রতি সম্পূর্ণ আয়োজনের, আমি বলি, আমি কাউকে তোয়াক্কা করি না, কাউকে আমি মানি না, আমার উবুদিয়াত আজ পরিপূর্ণতার অভিলাষী। হে প্রভু, সব দরজা বন্ধ হয়ে যাক, শুধু তোমার দরজা খোলা থাক। আমার অশ্রুর বাঁধ আমি অতিক্রম করেছি। আমি আর কিছু চাই না, চাই তোমাকে। ‘বল : আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব কর্মে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের? ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পণ্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সত্কর্মই করছে’ [১৮:১০৩]। আল্লাহর প্রতি সমর্পণ জীবন বদলে দেবে। আজ সেই শুভক্ষণ। আজকের সকালটা যেন অন্য রকম। নিজকে শুধরে নি’। ছেলেমেয়েদেরকে আর একটু বেশি ভালবাসি। যা শিখলাম, তা এক্ষুনি ওদেরকে জানিয়ে দি’। আল্লাহওয়া’লা হতে চলেছি। আল্লাহ সবসময় ডাক দিচ্ছেন ভালোর দিকে। আল্লাহর প্রতিটি কাজে সমর্থনের ইঙ্গিত পেয়েছি। কোনো ভয় নেই। তার তরফ থেকে অনেক উপহার প্রত্যক্ষ করছি। জানি কারও কাছে কোনো পুরস্কারের জন্যে উদগ্রীব নই। পুরস্কার তার কাছে। বেহেশতের খুশবু সামনে প্রবাহিত। জানতাম না, তা এত নিকটে। সত্যি কথা, অন্তরের কাদা হয়ে যাওয়া যেমন সহজ, তেমনি কঠিন। যখনই ভাবি একমাত্র তুমি ছাড়া আর আমার সাহায্যকারী কেউ নেই, তখনই সূরাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নব শক্তিতে হই উদ্ভাসিত। আগে যারা আল্লাহতে সমর্পিত হয়েছে, তাদেরকে মসজিদে দেখেছি। আগে বুঝতে পারিনি, কেন তারা ‘ইয়াকানাআ বুদু ওয়া ইয়াকানাস্তাইন’ বলার পর ঝর ঝর করে কাঁদত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দুয়েকজনকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। দেওয়ার পর বুঝলাম, এটা তারা অনুগ্রহ করে গ্রহণ করেছে। এটা তারা চায়নি। ইতিমধ্যে যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। যেখান থেকে পাওয়ার পেয়ে গেছে। হে প্রভু, অশ্রুর প্লাবনে তেমন পাওয়ার অধিকারী করে দাও, যেন তোমার এই সূরাগুলোকে বুঝতে পারি এমন পথে, যা নিশ্চিত বেহেশতের পথ।

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।  ই-মেইল : [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর