শিরোনাম
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১০:০৪
আ-মরি বাংলা ভাষা

বাংলা হবে সর্বজনের জীবনের মুখ্য বাহন

অনুপম সেন


বাংলা হবে সর্বজনের জীবনের মুখ্য বাহন

মানুষকে মানুষ করেছে ভাষা। ভাষা মানুষের অসাধারণ অর্জন। ভাষা ছাড়া মানুষ আজকের সভ্যতার যেসব প্রাপ্তি তাতে কোনো দিন পৌঁছতে পারত না। মানুষের মনোজগৎ ও বস্তুজগতের যে অসীম বিস্তার ও প্রসার আজ বিশ্বের বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে     আমরা দেখতে পাই, তা-ও ভাষারই সৃষ্টি, ভাষারই অবদান। ভাষার ওপরই নির্ভর করে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি। ভাষা তাই একই সঙ্গে একটি সমাজের উৎপাদনব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো এবং সে কাঠামোর উপরিসৌধ। 

একটি ভাষার জোর বা তার অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর নির্ভর করেই সে ভাষায় গড়ে ওঠে তার সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি। বাংলা দুর্বল ভাষা নয়। এটি একটি অত্যন্ত সবল ভাষা। এ ভাষায় আজ পর্যন্ত যে অর্জন ঘটেছে তার সম্ভার বিরাট। এ ভাষায় যেমন মহৎ কবি জন্মেছেন, তেমন জন্মেছেন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী যারা তাদের বিমূর্ত চিন্তার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন বিজ্ঞানকে। বর্তমান বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের তত্ত্বের একটি দিকের বিমূর্ত গাণিতিক ব্যাখ্যা যোগ করে সত্যেন বোস বিশ্বসভায় একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছেন, বিজ্ঞানে তার সূচির স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাঙালির যে বিপুল সৃষ্টি হাজার বছরে বিশেষত গত ২০০ বছরে গড়ে উঠেছে, তাতে বিশ্ববাসীকে সে তার অঙ্গনে গর্বের সঙ্গেই আমন্ত্রণ করতে পারে। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষা হিসেবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেতে বহু তরুণ-প্রাণের রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। বাংলা ভাষাই বিশ্বের একমাত্র ভাষা, যে ভাষার জনগণ ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। 

আজ নিজের ভাষাকে, মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই একসময়ের তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলো বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলোর কাতারে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জাপানের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় থেকে কম ছিল। আজ জাপান তের কোটি লোকের একটি দেশ, বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী দেশ, নিজের মাতৃভাষাকে জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে ব্যবহার করেই। জাপানের অভ্যন্তরীণ সম্পদ, কৃষিজ বা খনিজ সম্পদ কোনোটাই খুব বেশি নেই; জাপান ধনী হয়েছে নিজের মানবসম্পদের গুণে, নিজেকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করে, নিজের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, তারই প্রয়োগে। একই কথা দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। দক্ষিণ কোরিয়া এই সেদিনও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমার্ধেও একটা দরিদ্র দেশ ছিল, মাথাপিছু আয় বাংলাদেশ থেকে বেশি ছিল না। আজ কোরিয়া কোথায়? তারও এ অর্থনৈতিক উন্নতি তার মাতৃভাষার ওপর নির্ভর করেই, পুরো সমাজকে নিজের ভাষার মাধ্যমে একটা দক্ষ শিক্ষিত সমাজে পরিণত করে। 

তাহলে আমরা বাঙালিরা, জনসংখ্যার মাপকাঠিতে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠী, যে ভাষায় এত লোক কথা বলি, যে ভাষা এত সমৃদ্ধ, কেন এত কুণ্ঠিত নিজের ভাষাকে শিক্ষার প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে? আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকেই হতে হবে আমাদের সর্বজনের জীবনের মুখ্য বাহন, সর্বক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, মননের জগতে, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে। লেখক : শিক্ষাবিদ

 

বিডি-প্রতিদিন/ ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর