১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১২:১৮
প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

‘সুরা ফাতিহা’ প্রথম সুরা। মর্মবাণীর উপলব্ধির প্রয়োজন। স্বাদযন্ত্র অর্থাৎ জিভ সচল থাকলে যেমন পাওয়া যায় খাদ্যের স্বাদ তেমন ‘ফাতিহা’র মধ্য দিয়েই প্রবেশ করতে হয় পবিত্র কোরআনে। প্রতি নামাজে তাই এর উচ্চারণ। জীবন গড়িয়ে গেলেও একটি সুরাতেই প্রবেশাধিকার পাই না। গেয়ে থাকি : ‘একটা রোজা, একটা নামাজ আদমজাতে করলে সারে/তালাশ করগা আগে তারে’ [জালালউদ্দিন খান, ময়মনসিংহ, লোককবি]। বুঝতে পারি আল্লাহর অভিপ্রায়। একটি নামাজ ভালোভাবে পড়ি, আর এদিক-ওদিক নয়, সব সময় আল্লাহর নজরে বন্দি থাকি। বলি : ‘আল্লাহু মা-ঈ’, ‘আল্লাহু নাজিরি’, ‘আল্লাহু শাহিদি’। পাই ‘সা’ল তুশ্তারি’-র কাছ থেকে। তার নজরে বন্দি, আর কোথাও নয়, তার শাহি দরবারে সমাসীন, এই দরবার থেকে আর নড়ছি না। এর পরও আছে ‘স্পষ্ট জ্যোতি আল কোরআন’, সব সময় যা জ্যোতি বিচ্ছুরণ করছে। যাদের সঙ্গে ঘর করছি ভেবে দেখতে হবে যে আল্লাহর পথ এবং তাদের পথ একসঙ্গে মিশে গেছে কিনা। স ষ্টার পথের পথিক হয়ে থাকলে সঠিক পথেই আছি। ‘সিরাতাল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম’-এর অর্থ? চাই সে পথ, যে পথে তুমি দিয়েছ তোমার বরকত ও রহমত। অথচ সঙ্গী নির্বাচন বিপরীত। বাক্যটি তাদের স্মরণ করাতে যে যারা ইতোপূর্বে সার্থকতা লাভ করেছে, তাদের পথ চাই। পথটি নবীদের, ন্যায়বানদের, তাদের সঙ্গীসাথীদের এবং সবচেয়ে বেশি আমাদের নবীর (সা.)। তার পবিত্র জীবন চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে অশ্রুসিক্ত হই। কত কষ্ট তিনি করেছেন। তার তুলনায় আমরা সামান্যই কষ্ট ভোগ করেছি। ও কথা ভাবলে বর্তমান কষ্টের দিনগুলো মধুরতর হয়ে ওঠে। দুনিয়ায় শত কোটিরও বেশি মুসলমান। কী নিয়ামত পেলাম এ জীবনে। অথচ অধিকাংশই পেল না অধিকার, দু’মুঠো অন্ন। অভিশপ্ত যারা তাদের পথ আমাদের নয়। বলা হয়েছে : ‘গাইরুল মাগদুবি আলাইহিম’। অভিশপ্তদের ইতিহাস জানা কোরআন থেকেই। বলা হলো : ‘ওয়ালাদ্দুয়াল্লিন’ [তাদের পথ নয়, যারা সরে গেছে]। প্রার্থনা তারাও করে, অসমর্থিত পথে। জ্ঞানের অভাব অথবা বক্র পথ অনুগমন সৃষ্টি করেছে এমন অবস্থার। বরকত আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর কারও নয়, যখন বলা হলো ‘আনআমতা’ অর্থাৎ তুমি দিয়েছ। একমাত্র তিনি বরকত দেওয়ার মালিক। এ সুরাটি পাঠ করার পরই তোমার বরকতের মুখাপেক্ষী। এ সুরাটিতেই যদি থাকি পূর্ণভাবে মগ্ন ও সমর্পিত, যথেষ্ট। বিধাতা নন মূক ও বধির। তিনি তাকিয়ে হৃদয়পানে একটি সমর্পণের জন্য।

বেকুবদের কাছে আর নয়, তারা বন্ধু নয়, কোনো দিন ছিল না, এখনো নয়, কোনো দিন হবে না। বেকুব অর্থাৎ অন্য পথের পথিক। আল্লাহর পানে পেতেছি জায়নামাজ, মজলিসের শেষ হবে যে বাণী দিয়ে, সেই বাণী এখন উচ্চারণ করি। তা হলো : ‘আমিন’। ‘আমিন’ বলার সঙ্গে ফেরেশতাদের উচ্চারণ : ‘আমিন’, ‘আমিন’। আল্লাহর কাছে যা সেরা উচ্চারণ। ফেরেশতারা ‘আমিন’ শোনার জন্য উত্কর্ণ। কাবা শরিফে, মদিনায়, বাগদাদে, আজমিরে, ‘আমিন’ উচ্চারিত হওয়ার পর কিছু মুমিনকে পেয়েছি বেহুঁশ। চেষ্টা করি ‘আমিন’-এর তাত্পর্য খুঁজতে। ‘সুরা ফাতিহা’য় যা বর্ণিত, প্রতি শব্দ গেঁথে নিই’ নিজ হৃদয়ে। বার বার পড়ি, যেন অন্য কোনো মায়াজালে বন্দী না হয় এ হৃদয়, বেহেশতের সুবাতাস যেন হৃদয়ের কন্দরে নিয়ে আসে নতুন আবর্ত। যেমনটি কবির উচ্চারণ : ‘দে দোল দোল’। দুলতে থাকুক হৃদয় ‘আমিন’-এর আবর্তে। দুলছে পৃথিবী, এর সঙ্গে পৃথিবী দেখছে আমার পাগলপ্রায় হালত। ‘আমিন’-এর মূর্ছনা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। যারা শুনতে পাবে না, তারাও অচিরেই পাবে। নবী (সা.) বলেছেন ‘আমিন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে অগণিত ফেরেশতার ‘আমিন’ ধ্বনি উচ্চারিত। এক সালাতের এত মরতবা। তাহলে কেন এর পেছনেই সময় দেব না? ওদের দলে পড়ে কি চিন্তার ক্ষমতা রহিত হয়ে গেছে? বেকুবদের মজলিসে কী এমন আছে, যা ওই বাণীর চেয়েও মধুর? ‘আল-ফাতিহা’র মধুরতা নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর, কে পড়বে সেগুলো? রসুল (সা.)-এর দিকেই করি দৃষ্টিপাত। বলছেন : ‘তার নামাজ হয়নি, যে শুরু করেনি কোরআনের প্রারম্ভিক অধ্যায়’ দিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘সুরা ফাতিহা’। কবি এর সুন্দর বাংলা করেছেন, পাঠ করার সময় অনেকবার মনে হয়েছে এটি স্বয়ং আল্লাহর সমর্থনপুষ্ট। ‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি, বিচার দিনের স্বামী/যত গুণগান হে চিরমহান, তোমারই হে অন্তর্যামী/দ্যুলোক ভ্যুলোক সবারে ছাড়িয়া, তোমারই সকাশে পড়ি লুটাইয়া/তোমার কাছে যাচি হে শকতি, তোমারই করুণাকামী।/সরল সঠিক পুণ্য পন্থা মোদেরে দাও গো বলি, চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি’। ... [কবি গোলাম মোস্তফা]

আল্লাহ বলছেন : ‘প্রার্থনাকে ভাগ করেছি দুই ভাগে, একটি আমার, আরেকটি ভৃত্যের। ভৃত্য যা চাইবে, তাই সে পাবে’। যখন সে বলে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সবগুলো পৃথিবীর মালিক, আল্লাহ বলেন : ‘ভৃত্য আমার প্রশংসায় নিয়োজিত’। যখন ভৃত্য বলে, আল্লাহ করুণাময় ও প্রেমময়, তখন আল্লাহ বলেন : ‘ভৃত্য আমাকে মহিমা দিয়েছে’। যখন সে বলে বিচার দিনের স্বামী, তখন আল্লাহ বলেন : ‘ভৃত্য আমাকে দিয়েছে মহিমা। অথবা তার জীবনের সব কিছু আমার প্রতি সমর্পণ করেছে’। যখন সে বলে একমাত্র তোমাকে আমরা ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই আমরা সাহায্য চাই, তখন আল্লাহ বলেন : ‘এটা আমার ও আমার ভৃত্য সম্পর্কিত। সে যা চায়, তাই তাকে দেওয়া হবে’। যখন সে বলে, আমাদের দেখাও সরল পথ, সেই পথ যা তোমার পছন্দনীয়, যে পথ তোমার ক্রোধ জাগ্রত করে, তা নয়। যারা তোমাকে ছেড়ে গেছে, তা নয়। তখন আল্লাহ বলেন : ‘এটা আমার ভৃত্যের জন্য। সে যা চায়, তাই তাকে দেওয়া হবে’। এবার সালাতে দাঁড়ান। আপনার করুণাকামী সত্তার দিকে কী গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন তিনি। তাঁর অপরূপ মহিমান্বিত দৃষ্টি আপনাকে কীভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কী আনন্দ আজ তাঁর ভৃত্য হয়ে!

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব, ইমেইল :[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর